বালিকা বধুদের অজানা পৃথিবী এবং একজন নুজুদ আলী


শীর্ষছবি: আইনজীবি শাদা নাসের এর সাথে নুজুদ আলী (http://www.glamour.com/images/women-of-the-year/1028-nujood-ali-and-shada-nasser_aw.jpg)

“I’m a simple village girl whose family had to move to the capital, and I have always obeyed the orders of my father and brothers. Since forever, I have learned to say yes to everything. Today I have decided to say no.” – Nujood Ali

“I’m shaking–if they see me, they might arrest me. A little girl running away from home, that just isn’t done. Trembling, I discreetly latch on to the first passing veil, hoping to get the attention of the unkown women it conceals. A tiny voice inside me whispers, Go on, Nujood! It’s true you’re only a girl, but you’re also a woman, and a real one, even though you’re still having trouble accepting that..” – Nujood Ali

( নীচের লেখাটি প্রথম আলো ব্লগের জন্য প্রথম লিখেছিলাম ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সিনথিয়া গোরনীর To Young to Wed: The Secret World of Child Brides এর কাঠামো অবলম্বনে। সেই লেখাটিকে আরো একটু সম্পাদিত করলাম আমার নিজস্ব এই  ব্লগে প্রকাশের জন্য। লেখাটির পেছনে যে ছোট ইতিহাস আছে তা হলো : অফিসের মেন ফ্লোরে একটি বই এর দোকান আছে, প্রতিদিন আমি যেখানে লাঞ্চের সময়  ঢু মারি, সেখানেই গত বছর একটি বই, I am Nujood, Age 10 and Divorced এর প্রচ্ছদ আমার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। পরে এ বছর আবারও ন্যাট জিও র একটা ফটোগ্যালারীতে  দেখি সাহসী নুজুদের ছবি। আমার খুব সামান্য এই লেখা আমি ‍উৎসর্গ করতে চাই সেই সাহসী নুজুদ আলীকে:  সারা বিশ্বে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যে সাহসী প্রতিবাদের প্রতিকৃতি। )


I am Nujood, Age 10 and Divorced এর প্রচ্ছদ।

বাল্য বিবাহর উপস্থিতি সব মহাদেশে, ধর্মে, বর্ণে আর গোত্রে।

১৮ বছরের নীচে বিয়ে বাল্যবিবাহের সংজ্ঞায় পড়ে পৃথিবীর বেশীর ভাগ দেশেই, অনেক দেশেই এটি অপরাধ।  আসল সংখ্যা যদিও কারো জানা নেই, তারপরও  International Center for Research on Women (ICRW) এর মতে পৃথিবীতে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিবছর ১২ মিলিয়ন নাবালিকাকে বিয়ে দেয়া হয়। আর সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩৬ শতাংশ বিয়েই আসলে বাল্যবিবাহের সংজ্ঞায় পড়ে।

ভারতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সাধারণতঃ বিয়ে দেয়া হয়  তাদের থেকে হয়তো ৪ বা ৫ বছরের বড় কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের সাথে। আর ইয়েমেন, আফগানিস্থান এবং আরো কয়েকটি দেশে যেখানে বাল্যবিবাহের হার অস্বাভাবিক রকম বেশী, সেখানে অপ্রাপ্তবয়স্ক এই সব বধুদের স্বামী হয় সাধারণতঃ প্রাপ্তবয়স্ক তরুন বা মধ্যবয়সী কোন বিপত্নীক। কারন অনেক ক্ষেত্রেই এই বয়স্ক পুরুষরাই কেবল পারে কুমারীত্বর জন্য মেয়ের বাবাকে অর্থ যোগান দিতে। কখনো এই সব বিয়ের কারন দরিদ্র পিতার পক্ষে সামাজিক চাপ উপেক্ষা করার কোন উপায় থাকেনা। ইথিওপিয়ায় কিছু অঞ্চলে, এদের অপহরনকারীরা, যারা প্রথমে এদের অপহরন করে ধর্ষন করে এবং পরবর্তীতে তাদের বধু হিসাবে সামাজিকভাবে দাবী করে। এই বিয়ে আবার কখনও কখনও হয় একধরনের বানিজ্যিক আদান প্রদান, যেমন ৮ বছরের বালিকা বধু হয়তো কোন পারিবারিক ঋণশোধের একটি উপায়, বা ১৩ বছরের কোন ফুফাতো বা চাচাতো বোন, পারিবারিক বিরোধের নিষ্পত্তির একটি উপকরন।

এই সব ঘটায় যারা,এক মুহুর্তের জন্যও তারা চিন্তা করেনা,আসলে কি করতে যাচ্ছে তারা, একটা অপরিণত মন আর শরীরের শিশুকে তারা ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে। বহু দেশ তাদের আইনে বহুদিন আগেই নিষিদ্ধ করেছে বাল্যবিবাহ প্রথা । কিন্তু আজো অনেক দেশেই সামাজিক আর নৈতিকতার মোড়কে এর নীরব উপস্থিতি গ্রাস করে যাচ্ছে অনেক শিশুর নিষ্পাপ জীবন । ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী শুধু আফ্রিকায় ৪২ ভাগ মেয়েদের বিয়ে হয় তাদের ১৮ পুর্ণ হবার আগেই আর আফ্রিকার কোন কোন দেশে, যেমন নাইজারে এর হার প্রায় ৭৬ শতাংশ।

বিশ্বব্যাপী বাল্য বিবাহের  বিস্তার ( যে সমস্ত দেশে সার্ভে করা হয়েছে); সুত্র: http://www.unicef.org/publications/files/Early_Marriage_12.lo.pdf

২০ থেকে ২৪ বছরের বিবাহিত মহিলাদের শতকরা হার যাদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়েছে ( http://www.unicef.org/publications/files/Early_Marriage_12.lo.pdf)

১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার হার। সুত্র: http://www.unicef.org/publications/files/Early_Marriage_12.lo.pdf)


আফগানিস্থানের গোর প্রদেশে বাবার বাড়িতে বর ফাইজ মোহাম্মেদ (৪০) এর সাথে কনে ঘুলাম হায়দার (১১); সেই দিন কনেকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় কেমন লাগছে, হতবাক হয়ে তার উত্তর আমি তো এই লোকটাকে চিনিই না, আমার কেমন লাগা উচিৎ’; মাহমুদ হায়দার (৩২) কনের বাবা বলছিলেন তিনি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চান নি, কিন্তু তিনি এত দরিদ্র এছাড়া তার কিছু করার নেই।(http://www.stephaniesinclair.com/childbrides/)


আফগানিস্থানের গোর প্রদেশে চাভোশ গ্রামে বর সাইদ মোহাম্মেদ (৫৫) এর সাথে কনে রোশান কাশেম  (০৮); তাদের বিয়ের কথা পাকা হবার দিনে ।(http://www.stephaniesinclair.com/childbrides/)


আফগানিস্থানের  মাজার ই শরীফের উপকন্ঠে একটি গ্রামে মোহাম্মদ ফজল (৪৫)তার দুই স্ত্রী সহ মাজাবিন (বায়ে, ১৩), ডানে জালাঈহা (২৯); ৬ মাস আগে মাজাবিনকে বিয়ে করে ফজল, মাজাবিনের বাবা কোন এক রাতে ফজলের সাথে তাশ খেলা হেরে গিয়ে টাকা পরিশোধ না করতে পেরে মাজাবিনকে দিয়ে তার দেনা শোধ করেন।  (http://www.stephaniesinclair.com/childbrides/)


আফগানিস্থানের জালালাবাদের কাছে ঘরিশদি গ্রামে স্বামী মোহাম্মদ ওয়াজির (৫০) এর সাথে ১৬ বছরের জিয়াগুল, এবং তাদের এক বছরের ছেলে রাহমাদ ও প্রথম স্ত্রী হাদিয়া (৪০); জিয়াগুল এখন দ্বিতীয় বারের মত গর্ভবতী। ওয়াজিরের কাছে জিয়াগুলের পরিবার তাকে বিক্রি করেছে ১০,০০০ ডলারে। ওয়াজিরের ভাষায়, আমাকে সব কিছু বিক্রি করতে হয়েছে – আমার জমি, গবাদী পশু এই টাকা জোগাড় করতে’,ওয়াজিরের জমি মুলতঃ আফিমের জন্য পপি চাষের জন্য বেশী উপযোগী; তার আক্ষেপ,আমরা যদি পপি চাষ না করতে পারি, বিয়ে করাটা কঠিন হয়ে যাবে।   (http://www.stephaniesinclair.com/childbrides/)


ইথিওপিয়ার বালিকা বধু দেশতায়ে আমারে (১১), ট্রাডিশনাল ইথিওপিয়ার খৃষ্টীয় অর্থডক্স মতে বিয়ে দিনে।  (http://www.stephaniesinclair.com/childbrides/)


ইয়েকাবা কেরেবেত (১৫), তিন দিন ধরে প্রসব যন্ত্রনায় ভুগছে সে। অবশেষে তাকে তার আত্বীয়স্বজনরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। পরবর্তীতে তার ফিস্টুলা হয়, দীর্ঘকালীন প্রসবের ফলাফলে সচরাচর ফিস্টুলা হয়ে থাকে। অল্পবয়সী মাদের প্রসবকালীন সময়ে এ ধরনের নানা ঝুকি থাকে। উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশেই ফিস্টুলার হার অনেক বেশী। এবং দুঃখজনক ব্যাপারটা হলো যে নারীদের ফিস্টুলা হয়,তাদেরকে সমাজ মেনে নেয় না, কারন মনে করা হয় তারা ঈশ্বরের অভিশাপে অভিশপ্ত। (http://www.stephaniesinclair.com/childbrides/)


সুমিনা শ্রেষ্ঠা বালামী (১৫)বধু বেশে। নেপালের কিছু কিছু জায়গায় বাল্য বিবাহর খুবই প্রচলন। (http://www.stephaniesinclair.com/childbrides/)


নেপালের মিনা আচারিয়া (১৫) এভাবেই দুচোখ ভরা অশ্রু নিয়ে তার বাল্যবিবাহের অভিজ্ঞতার কথা মনে করছিল। স্বামীর সংসার থেকে পালানোর পর এই আশ্রয়টুকু তার মিলেছে Child Workers In Nepal Concerned Centre (CWIN) এ। (http://www.stephaniesinclair.com/childbrides/)


যখনই আমি তাকে দেখতাম, আমি লুকিয়ে থাকতাম, আমি তাকে সহ্য করতেই পারতাম না: তাহানী (পেছনে গোলাপী কাপড় পরা), মাজেদের সাথে তার বিয়ের প্রথম দিন গুলোর কথা মনে করে বলেছিল, তখন তার বয়স মাত্র ৬ আর মাজেদ ২৫; ইয়েমেনের হাজ্জার পাহাড়ী গ্রামে তাদের বাড়ীর সামনে ছবি তোলার জন্য দাড়িয়েছে আরো একজন বালিকা বধু, ঘাদা, তাহানী একসময়ের সহপাঠী)/ ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/ National Geographics)


বিয়ের অনুষ্ঠানের পর আত্মীয়াদের সাথে ইয়েমেনি বালিকা বধু ‍সিদাবা আর গালিয়াহকে তাদের স্বামীর বাসায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/National Geographics)

মাঝে মাঝে এধরনের একটি দুটি ঘটনা খবরের কাগজে পাতায় উঠে আসে, বিবেকবান মানুষের চোখে সামনে উন্মোচিত হয় এক অজানা জগত। ২০০৮ সালে এমন একটি ঘটনার নায়িকা ১০ বছর বয়সী একজর সাহসী ইয়েমেনী বালিকা: নুজুদ আলী। যে তার অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে পালিয়ে একা একা ইয়েমেনী আদালতে এসে হাজির হয়ে তালাকের আবেদন জানিয়েছিল। নুজুদ আলী এখন আবার লেখাপড়া শুরু করেছে, আর তার কাহিনী I am Nujood, Age 10 and Divorced রুপান্তরিত হয়েছে ৩০ টি ভাষায়।


নুজুদ আলী, ১০ বছর বয়সী যে মেয়েটি তার অত্যাচারী স্বামীর কাছ থেকে পালিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হয় সানা’র আদালতে তালাকের দাবী নিয়ে। শুরু হয় একটি ঐতিহাসিক আইনী লড়াই, যা তাকে রুপান্তরিত করে আন্তর্জাতিক নারী অধিকার আন্দোলনের নায়িকা হিসাবে। এখন তালাকপ্রাপ্তা নুজুদ ফিরে এসেছে বাসায় এবং স্কুলে যাচ্ছে  আবার, ‍ফিরে পেয়েছে বেচে থাকার স্বপ্নগুলো। (ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/ National Geographics)

মধ্যরাতের অনেক পরে ৫ বছরের রজনীকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বিয়ের আসরে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে তার কাকা। ভারতে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ, সে কারনে বিয়েগুলো হয় সাধারণতঃ খুব ভোরে, আর গ্রামের সবাই এই ঘটনা গোপন রাখে। ( ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/National Geographics)


রজনী আর তার বালক স্বামীর অগ্নিস্বাক্ষী রেখে বিয়ে হচ্ছে। ঐতিহ্যানুযায়ী বালিকা বধু বয়োঃসন্ধিকাল পর্যন্ত বাবার ঘরেই থাকবে।(ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/National Geographics)

কিছু কিছু সমাজে যেখানে পারিবারিকভাবে নির্ধারিত হয় এধরনের বিয়ে, সেখানে এই পরিবারগুলোর পক্ষে আসলে খুবই কষ্ট হয় এর ক্ষতিকর দিকটি অনুধাবন করতে, যেমন ভারতে..  বালিকা বধুর শিক্ষা জীবন শেষ হয় শুধু যে বাল্যবিবাহের কারনে তা না, গ্রামের স্কুলেও তার আর কোন পড়ার সুযোগ থাকেনা। তাকে পড়তে যেতে হলে কাছাকাছি কোন শহরে মানুষের ভীড়ে কোন বাসে চড়ে যেতে হবে, নিজেকে রক্ষা করতে হবে কিছু পুরুষের লালসা লোলুপ দৃষ্টি থেকে। বাসে করে যে শহরের স্কুলে তারা যাবে, সেখানেও হয়তো নেই কোন টয়লেট, যেখানে বয়সন্ধির এই মেয়েগুলো পরিষ্কার থাকার সুযোগ পাবে। আর তার উপর স্কুলে পড়ানোর খরচ তো আছে, যে খরচটা বেশীরভাগ পরিবারই খরচ করতে চায় তাদের ছেলে সন্তানের জন্য সুস্পষ্ট কিছু সামাজিক প্রথার কারনে। এছাড়া  পৃথিবীর বহু দেশেই মেয়েদের, তাদের যে নিজেদের জীবন সঙ্গী বেছে নেবার এবং কোথায় সে থাকবে, তা নির্ধারন করার কোন ন্যুনতম কোন অধিকার থাকতে পারে, সেই ব্যাপারটাই সামা‍‍জিক ভাবে স্বীকৃত না।


যদিও নেপালী গ্রামে বাল্যবিবাহ খুব স্বাভাবিক, তারপরও ১৬ বছরের সুরিতা তার বাবার বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রতিবাদ জানাচ্ছে কেদে, মাথায় ঐতিহ্যবাহী বিয়ের ছাতা দেয় টানা গাড়িতে করে স্বামীর বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে তাকে( ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/National Geographics)

দীর্ঘদিনের সামাজিক এই আচরন থেকে মানুষকে সচেতন করা প্রথম বাধাটাই আসে অন্তপুরের রমনীদের কাছ থেকে.. আমারও হয়েছে, তার হবে না কেন। যেখানে শিক্ষা অভাব আর দারিদ্রতার তীব্র সাড়াশী আক্রমন, সেখানে কোন বাবা হয়তো বলতেই পারে ঠিক আছে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দেব না, কিন্ত বলেন আপনারা তার সুরক্ষা দিতে পারবেন? কেউ যদি আমার মেয়েকে ধর্ষণ করে, কে বিয়ে করবে তাকে? এসব প্রশ্নের প্রতিকুলে কাজ করে সে সমাজকর্মীরা তারাও জানে সামাজিক বিভেদের নানা স্তরে রাষ্ট্র আর তার সুরক্ষার প্রতিজ্ঞাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান কতটিা আশার আলো দেখাতে পারে।


কান্দাহারের মহিলা পুলিশ মালালাই কাকার গ্রেফতার করেছেন একজন অপরাধী স্বামীকে যে তার ১৫ বছরের বালিকা বধুকে তার অবাধ্য হবার জন্য ১৫ বার ছুরি ‍দিয়ে কুপিয়েছে। যখন কাকারকে জিজ্ঞেস করা হয় কি হবে এই লোকের শাস্তি, কাকারের উত্তর কিছুই না। পুরুষ মানুষ এখানে রাজা।  মালালাই কাকারকে পরে তালিবানরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/ National Geographics)

ইয়েমেনে একধরনের প্রথা আছে: শীঘার, যেখানে দুই পরিবারের পুরুষ তাদের ‍নিজেদের আত্মীয়াদের একে অপরের স্ত্রী হিসাবে উপঢৌকন দেয়। প্রায়শই এই পদ্ধতিতে তারা একে অপরের কন্যা স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করেন। ব্যপারটা অতি প্রাচীন তবে শুধুমাত্র যখনই কোন সময় এই বিয়ে হয় অতিঅসম, তখনই নজর কাড়ে অন্যদের, যেমন, ১০ বছরের কোন বালিকার যদি বিয়ে হয় ৫০ বছরের কোন পুরুষের সাথে। ইয়েমেনে এধরনের অতিমাত্রার বাল্যবিবাহের প্রথা রুখতে সরকার অনেকদিন থেকেই আইন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ( যেখানে ১৭ বছর করা হবে বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স); এর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতা এবং এম পি মোহাম্মদ আল-হামজীর বক্তব্য হলো, যদি বাল্যবিবাহে কোন সমস্যা থাকতই, আল্লাহ একে হারাম করে দিতেন, যা আল্লাহ নিষেধ করেননি তা কি করে আমরা নিষিদ্ধ করবো“, এছাড়া হামজি আরো কিছু যুক্তি দেন, যেমর যদিও শারীরিকভাবে প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করার নিয়ম নেই, তারপরও ইসলামে কোন নির্দিষ্ট বয়স উল্লেখ করা নেই, ফলাফলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ধর্মীয়, পারিবারিক ও সামাজিক আচার অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় আইনে নয়।


পশ্চিম ইয়েমেনের গ্রামের কিছু বালিকা বধু (১৪ থেকে ১৬); লাজুক এবং চুপচাপ। যখন এদের সাথে লেখাপড়ার কথা বলা, তখন জানা যায় কেউ কখনো স্কুলে যেতে পারেনি, তবে সবার মনেই পড়াশোনা করার ইচ্ছার তীব্রতা কমেনি একটুও । ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/ National Geographics)

ইয়েমেনের সংসদীয় স্বাস্থ্য কমিটি প্রধান, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং ইসলামের একটি মিশ্র পাল্টা যুক্তি দেন: ইসলামে মানুষের দেহ খুবই গুরুত্পুর্ণ, এবং আধুনিক ইয়েমেনি পুরুষ যারা নাবালিকা বিবাহে উৎসাহী তারা ধর্মবিরোধী কাজ করছেন। নিঃসন্দেহে  অপরিণত বয়সে নারী দেহে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কুফল চিকিৎসাবিজ্ঞানে সুপ্রমানিত: প্রথমেই যোনী ক্ষতবিক্ষত হয়, যোনী পথের দেয়াল ভেঙ্গে যায়, মানসিক  ভাবে অপ্রস্তুত এই বালিকারা মুলত: ধর্ষিত হয়, শুধু যোনীই না আরো কিছু ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যেমন মুত্রথলী,মুত্রনালী পায়ুনালী, ফলাফল সারাজীবনের জন্য ফিস্টুলা। কখনো কখনো বালিকা বধূদের বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যুর জন্য গোপনে ফেলে আসা হয় হাসপাতালের বারান্দায়। এছাড়া প্রসবকালীন সমস্যাতো আছেই।

যেমন ইয়েমেনের ১২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়া ফাওজিয়া আম্মোদির  মৃত্যু হয়েছিল টানা তিনদিনের প্রসব যন্ত্রনায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে, তার সন্তানও বাচেনি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষনা বলে যে সব মেয়েরা ১৫ বছর বয়সের আগেই গর্ভধারন করে প্রসবকালীন সময় তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বিশোর্ধ গর্ভবতী মেয়েদের তুলনায় ৫ গুন বেশী। ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে ১৪ মিলিয়ন কিশোরী প্রতিবছর সন্তান প্রসব করছে।

আসিয়া, ১৪ বছর বয়সী মা, হাজ্জায় তার বাসায় তার সদ্যজাত কন্যাকে গোছল করাচ্ছে। এখনও আসিয়ার গর্ভপরবর্তী রক্তপাত হচ্ছে এবং অসুস্থ্য। কেমন করে তার নিজের যত্ন নেবে সেই তথ্য তার জানা নেই। ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www. stephaniesinclair. com) / National Geographics)

নিজেদের অজান্তে ইয়েমেনী সমাজের এই অন্ধকার অংশটি আলোয় নিয়ে এসেছে ১০ বছরের নুজুদ আলী। ইয়েমেনীদের নুজুদের এই ঘটনায় অবাক হবার কারন এই না যে, তার বাবা তাকে তার ৩ গুন বয়সী একজনের সাথে তাকে বিয়ে দিয়েছে, বা বিয়ের প্রথম রাত্রে তাকে ধর্ষন করে রক্তাক্ত করেছে তার স্বামী, যাতে নুজুদের শাশুড়ী এবং ননদ, বিছানা থেকে নুজুদের ওঠার আগে বিছানার চাদরে রক্তের দাগ দেখে নিশ্চিৎ হতে পারে… এসব কিছুই তাদের অবাক করেনি। তাদের চমকে ওঠার কারন নুজুদ এর প্রতিবাদে রুখে দাড়িয়েছে। ইয়েমেনী কয়েকজন সাংবাদিক যারা নুজুদের একা একা সানার আদালতে হাজির হবার ঘটনাকে ইয়েমেন এবং সারা বিশ্বের নজরে এনেছে তাদের একজনের  মতে..নুজুদ হচ্ছে সেই পাথর যা ই্য়েমেনী সমাজের বদ্ধ জলাশয়ে ঢেউ তুলেছে।

নুজুদ তার স্বামীর বাসা থেকে পালিয়ে প্রথমে নিজের বাসায় ফিরে আসে, জীবন বাজী রেখে সে অমান্য করে তার বাবাকে, যখন তার বাবা, তাকে স্বামীর বাসা থেকে পালিয়ে এসে পরিবারের জন্য অসন্মান বয়ে আনার জন্য দায়ী করে। তার নিজের মাও ভয়ে তার পাশে দাড়ায়নি। তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী নুজুদের পাশে দাড়িয়েছিলেন তাকে ট্যাক্সী ভাড়া আর কোথায় যেতে হবে সেই ঠিকানাটা দিয়ে।

সানার আদালতে ঘুরতে ঘুরতে বিচারকের সামনে আসার পর অবাক বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন একা একা রাজধানীর আদালতে সে কেন এসেছে? এর উত্তরে নুজুদ সুষ্পষ্টভাবে জবাব দিয়েছে, আমি তালাক চাই। এরপরে নুজুদের পাশে এসে দাড়িয়েছে ইয়েমেনের পরিচিত নারী আইনজীবি শাদা নাসের। খবরের কাগজে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী নুজুদ আলী একবিংশ শতাব্দীর বাল্যবিবাহের প্রতিবাদী নায়িকা হিসাবে আবির্ভুত হন। যেদিন আদালত তার তালাকের আর্জি মন্জুর করেন, সানার আদালত আনন্দে কেপে উঠেছিল মানুষের করতালিতে। নুজুদ আবার লেখা পড়া করেছে, তার বাবাও অনিচ্ছাসত্ত্বে তাকে মেনে নিয়েছে।


আইনজীবি  শাদা নাসেরের সাথে নুজুদ আলী। ২০০৮ সালে নভেম্বর মাসে, গ্ল্যামার উওমেন অব দি ইয়ার পুরষ্কার অনুষ্ঠানে) ফটোগ্রাফ: http://www.life.com/image/83639395)


রীম আল-নুমেরী (১২);  আরেক সাহসী বালিকা বধু: নুজুদের  মত সেও তালাক আদায় করে নিয়েছে। তার বাবার অত্যাচারে দু বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও সফল হয়নি রীম। তারপর বাড়ী থেকে পালিয়ে তার লড়াই করেছে।


জুলাই ৩০,২০০৮ সানার আদালত নুজুদ (বায়ে) এবং আরওয়া (ডানে) বিবাহ বিচ্ছেদ মন্জুর করেন। সেদিন সানা‘র কোর্ট হাউসের ভিতরে ছবি তোলার জন্য এভাবে দাড়িয়েছিল এই দুই সাহসী বালিকা।(ছবি: Khaled Fazaa/AFP/Getty Images)

সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্বে নুজুদ হচ্ছে ‘পজিটিভ ডেভিয়্যান্ট‘ এর উদহারন:  এরা সমাজের কোন একক মানুষ, ব্যক্তিগত পারিপার্শ্বিকতা এবং  নিজস্ব সাহসের একটা ভারসাম্যময় মিশ্রনের মাধ্যমে সক্ষম হয় সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টায়। নুজুদ, এর পর আরওয়া, তারপর ১২ বছরের রীম,  আদায় করে নেয় তার মানুষ হিসাবে বাচার অধিকার, এ ক্ষেত্রে তাকে জিততে হয় একজন বিরুদ্ধ মনোভাবাপন্ন বিচারকের মন।

নুজুদ আর রীমের মত প্রতিবাদে রুখে দাড়ায় ভারতের ১১ বছরের সুনীল, যে তার প্রতিবেশীদের সহায়তায় বাবা মাকে পাত্রপক্ষ আসার আগে হুমকি দিয়েছিল, সে তাদের পুলিশে দেবে, নয়ত জেলে যাবে তার বাবা মাথা ফাটিয়ে।


ভারতের রাজস্থানে যখন সুনীলের বাবা মা তার ১১ বছর বয়সে বিয়ের আয়োজন করে, সে তাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার ভয় দেখায়। তার বাবা মা পিছিয়ে আসে। এখন তার বয়স ১৩, স্কুলে যাচ্ছে সে, এখন অবশ্য তার মা বলে, পড়াশোনার করার কারনে সুনীলের এখন মর্যাদা আলাদা এই গ্রামে। ফটোগ্রাফ: স্টেফানী সিনক্লেয়ার (www.stephaniesinclair.com)/National Geographics)

এভাবেই  শুরু হোক আরো প্রতিবাদ।

 

বালিকা বধুদের অজানা পৃথিবী এবং একজন নুজুদ আলী

15 thoughts on “বালিকা বধুদের অজানা পৃথিবী এবং একজন নুজুদ আলী

  1. নুজুদের সাহসিকতার কাহিনী পড়ে চিন্তা করছিলাম আমাদের দেশেও একজন নুজুদ দরকার।

    হাসান ভাইয়া, ক্রমশ আপনার লেখার গুণমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।

    খুব ভালো থাকুন।

    Like

    1. পড়ার জন্য ধন্যবাদ . অনেক,,,,
      ঠিক.. কিন্তু আমরা যেভাবে বেচে আছি.. আত্মহত্যাটাই সাহসের কাজ হয়ে দাড়িয়েছে। দল বেধে আমরা একজনকে মৃত্যর স্বাদ নিতে বাধ্য করি..

      Like

  2. লেখাটি আরও একবার পরলাম। আর দশটা সামাজিক সমস্যার মত (সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীই অনেক সময় এগুলোকে সমস্যা মনে করে না, চর্চার কারনে) এই অমানবিক সমস্যাটিরও মূল বা প্রধান কারন আমাদের নৈতিক বোধের সাথে এতটা গেড়ো হয়ে রয়েছে যে আমূল পরিবর্তন আসছে না।
    ধর্ম, ভৌগলিক রীতি-নীতি ও তার স্পর্শকাতর আবেদন শুভ পরিবর্তনকে বাধা দিচ্ছে। বাল্যবিবাহও তেমন একটা আমুল পরিবর্তন-প্রত্যাশি সমস্যা। যা হাজার বছর ধরে চর্চা হয়ে আসছে বিভন্ন সমাজে।
    আমি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষনই বলছি, সেই শৈশব থেকেই দেখে আসছি আমাদের পরিবার সমূহে মেয়েদের অবস্থান।পুত্র আকাঙ্খায় অনিয়ন্ত্রিত জন্মদান, অনাকাঙ্খিত ভাবে কন্যা সন্তানের জন্ম। এবং শৈশব-কৈশোরেই তাকে বিয়ে দিয়ে বোঝা থেকে মুক্তি চেষ্টা, যা কিনা সমাজ ও ধর্ম স্বীকৃত। শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও দরিদ্রতা থেকে ক্রমান্বয়ে মুক্তি যদিও বাল্যবিবাহের হার কমিয়ে আনছে, কিন্তু তা মোটেও আশানুরুপ নয়।
    নুজুদ আলী’র মত আমাদের দেশের অনেক মেয়েও এই নোংরা-অমানবিক চর্চার শিকার হয়েছে- হচ্ছে। কেউ কেউ সেবামূলক ও এনজিও এর সহায়তায় মুক্তি পাচ্ছে, কিন্তু তাদের ভবিষ্যত শংকামুক্ত হয়েছে কি। সমাজ-সংসার এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটা কিশোরী কতক্ষন যাবৎ প্রতিবাদী মানসিকতা বাচিয়ে নিজের দেখভাল করার ক্ষমতা রাখে?
    আরও অনেক নুজদ আলী জন্ম নেক। তাদের দেখে মানুষের মনের বদ্ধতা দূর হয়ে সেখানে মানবিক শুভময়তার বীজ অঙ্কুরিত হোক।
    অসাধারন লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। শুভ কামনা।

    Like

  3. ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো জড়ো হয়েই বড় পরিবর্তনের পথটা উন্মুক্ত হয়… বিভিন্ন সভ্যতার মিশ্রণ এখন আমাদের নৈতিক অবস্থানগুলো প্রশ্ন করার পরিবেশ সৃষ্টি করছে; সমস্যাটা হচ্ছে সামান্য কিছু পরিবর্তনের জন্য আসলে আরো অনেককিছুর একই সঙ্গে পরিবর্তন দরকার। শিক্ষার যেমন বাড়াতে হবে, শিক্ষাকে ব্যবহার করা সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, আইনগত পরিবর্তন আনতে হবে, মানুষের মানবাধিকারকে আর্থসামাজিক শোষনের সমীকরণ থেকে বের করে আনতে হবে রাষ্ট্রীয় ভাবে সংরক্ষন করার মত একটি ধ্রুব সত্য হিসাবে… অনেক পরিবর্তন দরকার, একক ভাবে ঘটা পরিবর্তন গুলোই একসময় তার ক্রিটিকাল মাস তৈরী করবে স্থায়ী পরিবর্তনের…

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান