মনু এস. পিল্লাই-এর একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে
তার নাম ছিল নাঙ্গেলি এবং তিনি চেরথালায় বাস করতেন, কেরাল উপকূলের উপকূলের পানি পরিবেষ্টিত একটি বর্ধিতাংশ। আমাদের জানা নেই তিনি কবে জন্ম গ্রহন করেছিলেন অথবা কে তাকে জন্ম দিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে তিনি উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে মারা গিয়েছিলেন, এবং তার মৃত্যুর পর অতিক্রান্ত দুই শত গ্রীষ্মে শতাধিক ভিন্ন ছাঁচে তার আত্মার পূনর্জন্ম হয়েছে। ইন্টারনেটে আজ নাঙ্গেলির বহু সমর্থক আছেন, তার গল্প বলছেন সেই নারী পুরুষরা যারা তাদের বর্তমান এই সময়ে অনুপ্রেরণা আর সাহস খুঁজছেন। এবং তারাও নাঙ্গেলির বিসর্জনকে নতুন ছাঁচে উপস্থাপন করেছেন, এমন একটি কাহিনি সৃষ্টি করেছেন, যা এর মূল চরিত্র নাঙ্গেলির কাছেই অবোধ্য মনে হতো। নাঙ্গেলি সমাজের হৃৎপিণ্ডে ছুরিকাঘাত করা একজন নারী থেকে এমন একজন নারীতে রূপান্তরিত হয়েছেন, যিনি ঔসব ধূর্ত প্রতারণাপূর্ণ শৃঙ্খলের জন্য প্রাণ দিয়েছিল, যাকে আমরা অনেকেই ‘অনার’ বা সন্মান হিসেবে চিনি।
এই কাহিনির রূপরেখা সুপরিচিত। নাঙ্গেলি ও তার পুরুষ, চিরুকন্দন ছিলে ‘এজহাভা’ – যারা মূলত ‘টডি ট্যাপার’ অর্থাৎ নারিকেল বা তালগাছের ফুল থেকে যারা নির্যাস সংগ্রহ করেন, পরে সেটিকে ‘টডি’ নামে মৃদু অ্যালোকোহল পানীয় তৈরি করা হয়।। এজহাভা সমাজের সেই অস্বস্তিকর শূন্যস্থানে পরিশ্রম করে বাঁচেন, সমাজ যাদের শ্রেনীভূক্ত করে নিচু জাত হিসেবে, তবে সবচেয়ে নিচু জাত নয়। তাদের ছোট একটি কুটির ছিল যেখানে তারা বাস করতেন, এবং তাদের কোনো সন্তান ছিল না। নাঙ্গেলি ও চিরুকন্দনের জন্য জীবন তাদের যে-কোনো প্রতিবেশির মত কঠোর আর নির্মম ছিল। তারা দিনে এনে দিনে খেতেন, জাতপ্রথার বেধে দেয়া নিয়ম মেনে চলতেন, সমাজের উচু জাতের মানুষদের অহংকারের প্রতি নতজানু হতেন। নাঙ্গেলি প্রতিবাদ করার আগ পর্যন্ত তাদের কোনো কিছুই বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল না। সমাজের মুরুব্বীরা দাবী করেছিলেন যে, নাঙ্গেলি তার সন্মান রক্ষার্থে এই প্রতিবাদী অবস্থান নিয়েছিল, কিন্তু এমন কিছু বলার কারণ ছিল তারা সেই সত্যটি স্বীকার করতে আতঙ্কিত হয়েছিলেন – নাঙ্গেলি আসলে তাদের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিলেন। নাঙ্গেলি বিদ্রোহী ছিলেন, এবং বহু বিদ্রোহীর মতোই মৃত্যুতে তার স্মৃতি তিনি যাদের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। তিনি নিপীড়কদের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার ঐতিহ্য এখন অন্য নিপীড়কদের হাতের মুঠোয়।
যে কেরালা নাঙ্গেলি আর চিরুকন্দন জানতেন সেটি আজকের আধুনিক কেরালা নয়। এর স্বাস্থবান শিশু, স্বাধীন পিতামহী-মাতামহী আর শিক্ষিত জনগণের জন্য যে কেরালা নিয়ে উচ্ছাস করা হয় এটি সেই কেরালা নয় । এটি ছিল কঠোর, নিষ্ঠুর একটি এলাকা, আর ত্রিবাঙ্কুর (ট্রাভাংকোর) মানচিত্রে চেরথালা ছিল ক্ষুদ্র একটি বিন্দু – যে রাজ্যটির একজন স্বাধীন রাজা ছিলেন। যে রাজার প্রতি তারা কর আর আনুগত্যের প্রতিশ্রুতে আবদ্ধ ছিলেন। ভূমির কর ছিল কম, কিন্তু রাজারা তাদের পূর্বসূরিদের এই ভুল শোধরানোর চেষ্টা করেছিল বিচিত্র ধরনের রাজস্ব আরোপ করে। যদি আপনি ভূমিহীন মৎসজীবী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার মাছ ধরার জালের ওপর আপনাকে কর দিতে হবে। আপনি যদি পুরুষ হন, এবং গোফ রাখতে পছন্দ করেন, তাহলে কর আদায়ের জন্য সেটি কর পরিদর্শকের এখতিয়ারের মধ্যে থাকবে। যদি আপনার দাস থাকে, তাহলে আপনাকে ঔসব জীবন্ত রক্তমাংসের জন্য কর দিতে হবে। নাঙ্গেলি ও পুরুষ চিরুকন্দন অনুগত প্রজার মতো রাজ্যে নিয়ম মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে যারা এই গল্পটি বলছেন তারা আপনাকে বলবেন যে তিনি একটি ঘৃণ্য করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন যা কিনা তার ‘সন্মানের’ সেই নাজুক বিষয়টিকে স্পর্শ করেছিল। আত্মমর্যাদা আছে এমন কোনো নারীর মতো যখনই এটি তার অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে, তিনি ঘোষণা করেছিলেন – ‘আর নয়’।
তারা একদিন সকালে এসেছিলেন – কাহিনি আমাদের যেভাবে বলে। কর পরিদর্শকরা স্তনের ওপর কর আদায় করতে এসেছিলেন, লালসাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তারা এর আকার ও মাপ বোঝার চেষ্টা করেছিল করের পরিমান হিসাব-নিকাশ করে বের করেছিলেন। এই করটির নাম ছিল ‘মুলাক্কারাম’ – স্তন কর – আর যে নারীরা উচ্চ জাতের নয় তারা কৈশোরে প্রবেশ করার পরপরই তাদের জরিপ করা হতো। নাঙ্গেলিকে সম্ভবত বহু বছর ধরে একই কর দিতে হয়েছিল, কিন্তু সেই বছর যখন কাহিনী রাজকীয় খলনায়করা তার কুটিরে এসেছিল, তিনি প্রস্তুত ছিলেন সেই কাজটি করার জন্য, যা তাকে ইতিহাস আর লোককাহিনিতে জায়গা করে দিয়েছিল। যখন রাজার কর্মকর্তা তার দরজার চৌকাঠে দাড়িয়ে ছিলেন, তিনি শান্তভাবে তার ঘরের ভিতরে ঢুকেছিলেন, এবং বলা হয়ে থাকে যে, তিনি একটি কলাপাতা করে তার করের অর্পণ নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। যেহেতু তারা স্তনের কর সংগ্রহ করতে এসেছেন, ঠিক সেটাই তারা পেয়েছিলেন: নাঙ্গেলির দুটি স্তন – যা তিনি নিজ হাতে কেটে তার শরীরে থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন, আর রক্তাক্ত পিণ্ডের মতো কলাপতার ওপর রেখেছিলেন। কিছু মুহুর্তের মধ্যে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ও তীব্র যন্ত্রণায় প্রাণ হারান। চিরুকন্দন তার মৃতদেহ কোলে তুলে নিয়েছিলেন , যে কেবলই বাড়ি ফিরে আবিষ্কার করেছিল তার কুড়ে ঘরটি ইতিহাসের অন্যতম একটি ট্রাজেডির স্থানে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলেন তিনি নাঙ্গেলির চিতার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিলেন, শোকের অগ্নিশিখায় আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, এমনকি তার জন্যও এটি ছিল পরিত্রাণের বিসর্জন।
রক্ত আর অন্যায়ের মধ্য দিয়ে নাঙ্গেলি কিংবদন্তীর জন্ম হয়েছিল । এই কিংবদন্তী আপনাকে বলবে যে, নিম্নবর্ণের নারীরা তাদের স্তন আবৃত করতে পারত না, যদি না তারা স্তন কর পরিশোধ না করত। তারা নীরবে অশ্রুপাত করেছে এবং তাদের নিয়তি নিয়ে বিলাপ করেছে, লজ্জার ওপর লজ্জার আস্তরণ জমেছিল লোলুপ বৃদ্ধ পুরুষদের দৃষ্টির কারণে, যারা নিয়ম জারি করেছিলেন যে, সন্মানের জন্য মূল্য পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু নাঙ্গেলি ছিল পূন্যবতী নারী, তিনি তার সন্মানের জন্য কোনো অর্থ বিনিময় করতে রাজি ছিলেন না, এবং সেই কারণে তিনি মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন। এবং তাদের নিজেদের প্রবর্তিত আইনে বিব্রত আর আতঙ্কিত হয়ে রাজা স্তনের ওপর কর আরোপ করার নিয়মটি বাতিল করে দিয়েছিলেন, নাঙ্গেলি বীরাঙ্গনায় পরিণত হয়েছিল এবং নারীত্বের জয় হয়েছিল।
এটাই হচ্ছে কাহিনি যা আপনি নাঙ্গেলি সম্বন্ধে এখন শুনবেন। কিন্তু বাস্তবিকভাবে এটি মিথ্যা ও বিকৃত একটি উপস্থাপন।
কেরালার মতো একদা উন্মুক্ত পরিবেশের একটি রাজ্যে স্তন ভিক্টোরিয়ান যুগে বেশ উদ্বেগের কারণে পরিণত হয়েছিল। এটি ছিল সেই দেশ যেখানে পর্তুগীজ বনিকরা ষোড়শ শতাব্দীতে উন্মুক্ত বক্ষা রাজকুমারীদের দেখেছিলেন বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে কিংবা নগ্নবক্ষ রানিকে সৈন্যদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে। এখানে এখন সপ্তদশ শতাব্দী ইটালির একজন নাগরিক নিজেকে একজন রাজার দরবারে আবিষ্কার করেছিলেন, যা পুর্ণ ছিল রাজকীয় নারীদের দিয়ে যাদের শুধু কোমর আবৃত করে রাখা ছিল – রাজার দুই তরুণী ভাইঝি কী কারণে এই বিদেশি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় তাপে এই ধরনের পোষাক পরে আছে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। এটা ছিল সেই দেশ, যেখানে নারীরা তাদের শারীরিক এবং যৌন স্বাধীনতা ভোগ করতেন, যেখানে বৈধব্য কোনো বিপর্যয় ছিল না, এক স্বামীকে অনায়াসে আরেক স্বামী দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যেত। এই উপকূল বিস্তৃত হয়ে আছে বহু বীরাঙ্গনার কাহিনি – মালাবারের উত্তরাঞ্চলীয় গীতিকবিতার উন্নিয়ারচা – নাঙ্গেলির জাতের একজন দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন যিনি – থেকে আট্টিঙ্গালে উমাইয়ামা অবধি, যে রানি রাজাদের ওপর শাসন করেছিলেন। এছাড়াও আরো ব্যক্তিত্বপূর্ণ সাহসী নারীরা ছিলেন। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে কেরালার নৈতিক বিবেক তাদের অর্জন যতটা আঁকড়ে ধরে ছিল, এই অলজ্জ নগ্নবক্ষতা যে কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন সেটি নিয়ে তারা ততটা ব্যতিব্যস্ত হয়নি।
বর্তমানে এর পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞায় যেভাবে আমরা ভার্চু বা পূণ্য ধারণাটিকে শনাক্ত করি, ধারণা হিসেবে এটির কেরালায় অস্তিত্ব ছিল না। এবং যতদিন না আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভুরা – এবং পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে আসা স্বদেশীরা – সেখানকার প্রাধান্য বিস্তারকারী গোষ্ঠীগুলোকে পরিপৃক্ত করে রাখা মাতৃকূলভিত্তিক প্রবণতা নিয়ে বিচারে বসেছিলেন, তার আগে নারীরা, তাদের নগ্ন বক্ষ ও যৌন স্বাধীনতার বিষয়টি আদৌ কারো দৃষ্টি আকর্ষণ অথবা ঘৃণার উদ্রেক করেনি। যখন কিনা সর্বত্র বহুগামিতা পুরুষদের জন্য স্বাভাবিক ছিল, কেরালায় এক নারীর বহু পুরুষের সাথে মিলিত হবার বিকল্প বা বহুভর্তৃত্ব প্রথা অনুসরণ করার উপায় ছিল, কারণ সেখানে নারীরা তাদের ভাইদের অসমান ছিলেন না ( অথবা আরো সুনির্দিষ্টভাবে, তারা বরং ভাইদের চেয়ে আরো খানিকটা বেশি মর্যাদা ভোগ করতেন)। তারা সম্পদের মালিক হতেন এবং সম্পদের উৎস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেতন, অন্যত্র গৃহপালিত সন্তান জন্ম দেয়ার নিয়তি নিয়ে জন্ম নেয়া বোনদের ব্যতিক্রম তারা পূর্ণ একটি জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু অবশ্যই এই সুবিধাটা পেয়েছিলেন উচ্চবর্ণের নারীরা যারা বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত। নাঙ্গেলির মতো নারীদের জন্য সেনাবাহিনী বা গীতিকবিতার বিরোচিত জীবনে কাটানোর প্রশ্নই ওঠে না। প্রতি দিনের অনিশ্চয়তার মধ্যে তাকে তার জীবিকা অর্জন করতে হতো। মৃত্যুর পরেই গীতিকবিতা এসেছিলেন এবং সেগুলো নাঙ্গেলির মূল বার্তার ওপর মনোযোগ দেয়নি, বরং বিকৃতভাবে এটি উপস্থাপন করেছিল যেন সেটি পরিবর্তিত সামাজিক রীতিনীতির কাছে আরো রুচিসম্মত হয়।
ব্রিটিশদের আগমন নতুন রাজনৈতিক কাঠামো সৃষ্টি করা ছাড়াও আরো বেশি কিছু ছিল। তারা কেরালায় নৈতিকতার একটি নতুন ধারণা নিয়ে এসেছিলেন, যা আরও দৃঢ়ীকরণ করেছিল খ্রিস্টান মিশনারিরা, যাদের কথা এই ভিনদেশী প্রভুরা শুনতেন। বহুপতি গ্রহন করার প্রথা অত্যন্ত অগ্রহনযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল, নারীদের বলা হয়েছিল তাদের পুন্যবান হওয়া উচিত, যার অর্থ একজন স্বামীর প্রতি সন্মান প্রদর্শন, একজন প্রভু। এছাড়া তাদের শালীনতাবোধ বজায় রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, এবং নগ্নবক্ষ থাকা সেই দিক বরাবর কোনো পদক্ষেপ ছিল না। পিতৃতান্ত্রিক ভিক্টোরিয়ানদের যৌন দৃষ্টি কেরালার স্তনের প্রতি নির্দেশিত হয়েছিল, এযাবৎ যা কোনো সমস্যার কারণ হয়নি। যখন নারী ও পুরুষরা মন্দিরে প্রবেশ করত, উভয়েই তাদের শরীরের উপরের আবরণ সরিয়ে ফেলত। আজ শুধু পুরুষরাই এই কাজটি করতে বাধ্য হয়। ১৯২০-এর দশকেও, যখন নামবুথিরি ব্রাহ্মণ নারীরা প্রথম বারের মতো নিজেদের স্তন আবৃত করতে ব্লাউজ যোগাড় করেছিলেন, কেরালার শুদ্ধবাদীরা সামাজিক আচার ভঙ্গ করার জন্য তাদের সমাজচ্যুত করেছিলেন – তারা দাবী করেছিলেন শালীনতা ও সত্যিকারের নৈতিক শ্রেষ্ঠতা অবস্থান করছে তাদের নিজেদের বক্ষ আবৃত না করার মধ্যেই। যেভাবে অব্রি মেনেন তার আইরিশ মায়ের প্রতি তার দাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, তখন ভাবা হতো, ‘বিবাহিত নারীরা যারা ব্লাউজ পরেন, তারা সব জেজেবেল’, এবং ‘একজন স্ত্রী যিনি নিজেকে এভাবে সজ্জিত করেন, তিনি নিশ্চয়ই পরকিয়া করার উদ্দেশ্যেই সেটি করেন’। স্তন আবৃত করে রাখা, কারণ তরুণ পুরুষরা সেটি করতে দাবী করছে, বয়স্কদের কাছে ঘৃণ্য ও অগ্রহনযোগ্য ছিল। কিন্তু বয়োজ্যোষ্ঠরা তরুণ প্রগতিশীলদের তুলনা সংখ্যায় কম ছিলেন, যারা তাদের নারীদের পূণ্যবতী বানাতে বদ্ধ পরিকর হয়েছিলেন।
পুরো উপকূল জুড়েই নারী ও পুরুষ উভয়েরই শরীরের উর্ধাংশ,– এমন কিছু ছিল না যে আবৃত করে রাখা হতো। উচ্চ জাতের সদস্যরা মাঝে মাঝে শাল ব্যবহার করতেন, তবে সেটি শালীনতার কারণে নয় কিংবা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পূণ্য সংক্রান্ত ধারণার সাথে যা কিনা বেশি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, বরং এর কারণ ছিল শাল হচ্ছে সন্মানের প্রতীক। যখন নিম্ন জাতের খ্রিস্টান ধর্মান্তরিতরা ১৮৫০-এর দশকে নিজেদের আবৃত করতে শুরু করেছিল, দাঙ্গা বেধে গিয়েছিল যখন সহিংস উচ্চবর্ণীয়রা তাদের ওপর আক্রমণ করেছিল। বিতর্কের কেন্দ্রে এমন কিছু ছিল না যে, ধর্মান্তরিত নারীরা নিজেদের নিজেদের আবৃত করতে চেয়েছিলেন, বরং মূল কারণ ছিল তারা নিজেদের শাল দিয়ে আবৃত করেছেন যা শুধু উচ্চ বর্ণের জন্য সংরক্ষিত ছিল। শান্তি রক্ষা হয়েছিল যখন ধর্মান্তরিতরা ব্লাউজ আবিষ্কার করেছিলেন, আবৃত করে রাখার বিষয়টি আদৌ মূল সমস্যা ছিল না।
নাঙ্গেলির কাহিনি যা আপনাদের তারা বলবে সেখানে সন্মান রক্ষা করার জন্য তার সংগ্রামের কথা আছে। যেখানে ‘সন্মান’ ধারণাটি নির্মিত হয়েছে বা উপস্থাপিত হয়েছে তার স্তন আবৃত করে রাখার অধিকার হিসেবে। কিন্তু নাঙ্গেলির সময়, নারীর সন্মান তার কোমরের উপরে কোনো এলাকার সাথে আদৌ যুক্ত ছিল না। যেভাবে এফ. ফসেট মন্তব্য করেছিলেন, ‘পোষাক হচ্ছে প্রথার ব্যাপার, এবং অনুশোচনার বিষয় হবে যদি ভ্রান্ত লজ্জার ধারণা স্বাভাবিক সন্মানের ধারণাটিকে প্রতিস্থাপিত করে, যেভাবে সেটি প্রকাশ করা হয়ে থাকে কোনো সুপ্রতিপালিত ভদ্রমহিলার আচরণের সাথে’। কিন্তু ভিক্টোরিয়ান পিতৃতান্ত্রিকতার আমদানী করার সাথে লজ্জাও আমদানী করেছিল, এবং নারীদের বলা হয়েছিল যে একটি নগ্ন শরীর ‘সন্মানহীনতার’ চিহ্ন। সন্মান আছে পুরুষের দ্বারা মর্যাদাহীন বস্তুকরণের মধ্যে। মর্যাদা অবস্থান করছে বাধ্যতায়। পুরুষেরা বড় শহরগুলোয় কলেজে যারা অধ্যয়ন করছিলেন, তারা তিরষ্কারের শিকার হয়েছিলেন তাদের নগ্নবক্ষা মায়েদের নিয়ে, যাদের হয়তো একাধিক স্বামীও থাকতে পারে। তারা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারেন, তাদের পিতা কে? তারা তাদের পিতৃতান্ত্রিক কথকদের পৌরুষত্ব টেনে নিয়ে এসেছিলেন কেরালায়, এবং নারীরও, পশ্চিমা প্রথার সংস্পর্শে এসে নারীত্বের একটি নতুন ধারণা আত্মস্থ করেছিলেন, এবং মেনে নিতে শুরু করেছিলেন। ১৮৯২ সালে এলাকার সবচেয়ে প্রাচীনতম নারীদের ম্যাগাজিন দাবী করেছিল, ‘আমরা রাজনীতি সংক্রান্ত কিছুই প্রকাশ করবো না’। তারা আরো বলেছিলেন, ‘নৈতিক বিবেককে শক্তিশালী করে এমন লেখা’ – রান্না সংক্রান্ত উপদেশ, আদর্শ নারীদের কাহিনি – এবং ‘অন্যান্য আলোকিত বিষয়’ শুধুমাত্র এই পত্রিকায় প্রকাশ হবে। বাড়িতে ‘একজন ভদ্রমহিলার কাজ হচ্ছে একজন মা, বিশ্বস্ত স্ত্রী এবং গৃহব্যবস্থাপক হিসেবে, বাইরে নগ্নবক্ষা বেশ্যা হিসেবে নয়, যারা তাদের প্রথাগত বিবাহ বিচ্ছেদ করার অধিকার সংরক্ষণ করেন’। আরেকটি ঘোষণা যেমন দাবী করেছিল, আমাদের ঈশ্বর প্রদত্ত কর্তব্য হচ্ছে ঘর পরিচর্যা করা, এবং স্বামীকে সেবা করা’।
নতুন পুজনীয় রূপ বা প্রতীকী চরিত্র খুঁজে পাওয়ার দরকার ছিল, আর যে নারীরা এই নতুন পদ্ধতির দৃষ্টান্ত হবার যোগ্য তারা ছিলেন এখন ঘৃণ্য নগ্নবক্ষা অতীতের প্রতীক। আর যখন এই ধরনের নারীদের সরবরাহে টান পড়েছিল, ইতোমধ্যে অস্তিত্ব ছিল এমন নারীদের পুনর্জন্ম দেয়া হয়েছিল যেভাবে জে. দেবিকা প্রদর্শন করেছিলেন, আট্টিঙ্গালের উমাইয়ামা, সেই নগ্নবক্ষা রানি যার অভিজাত, ‘মহৎ আর পুরুষালি’ আচরণের জন্য ওলন্দাজরা লক্ষ করেছিলেন। তারা লিখেছিলেন, ‘রানিকে সবাই ভয় পায় এবং শ্রদ্ধা করে, এবং যিনি আসলেই ‘তরুণী আমাজন’। এই অসাধারণ নারী এস. পরমেশ্বর আইয়ারের কবিতায় অসহায় এক নারী হিসেব আবির্ভূত হয়েছিলেন, অসহায় এক মা ( বাস্তবিকভাবে তার কোনো সন্তানই ছিল না), যিনি একজন পুরুষ সুরক্ষকের জন্য মিনতি করছেন। যেখানে ইংরেজরা একসময় জানিয়েছিলেন যে ( হয়তো খানিকটা অতিরঞ্জিত করে) ‘ দেশের সবচেয়ে সুদর্শন তরুণদের’ দিয়ে তার হারেম তৈরি হয়েছে, এবং তারা ও তার ইচ্ছামত যে কোনো সংখ্যক পুরুষ তার শয্যাসঙ্গী হবার সন্মান অর্জন করত, কিন্তু পরর্ব্তী সময়ের এই কবিতায় তিনি একজন অনুগত, নারী সদগুণের পিতৃতান্ত্রিক পুজনীয় রূপে পরিণত হয়েছিলেন। অতীতের নারীরা বর্তমানের গুরুত্বহীন চরিত্রে পরিণত হয়েছিল, সন্মান যুক্ত হয়েছিল, তাকে আচ্ছাদিত করেছিল পুরুষের তৈরি কাপড়। সময়ের চাকা আবর্তিত হয়েছিল, আর এটাই দরকার ছিল কেরালায় পরিবর্তিত হতে থাকা সমাজে।
নাঙ্গেলিও নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। যখন নাঙ্গেলি তার স্তন জোড়া কলাপাতার ওপর রেখে রাজকর্মকর্তাদের নিবেদন করেছিলেন, তিনি তার স্তন ঢাকবার অধিকার কিন্তু দাবী করেননি, কারণ এই অধিকার নিয়ে তার আদৌ চিন্তিত থাকার কথা নয়, কারণ এর কোনো অর্থই ছিল না তার সময়ে। আসলে মুলাক্করমের স্তনের সাথে খুবই সামান্যই সংযোগ ছিল, শুধুমাত্র নামরকরণসংক্রান্ত একটি অস্পষ্ট সংযোগ ছাড়া। এটি একধরনের পোল ট্যক্স বা মাথাপিছু করের মতো একটি বিষয় ছিল যা নিম্ন বর্ণ ও সংখ্যালঘিষ্ট সমাজগুলোর ওপর আরোপ করা হতো। পুরুষদের জন্য একই ধরনের কর ছিল – তলাক্করম – মাথা কর – যা পুরুষ করদাতাকে নারী করদাতা থেকে পৃথক করত কোনো একটি গৃহস্থালীতে, আর নারীদের মাথার সেই করটির নাম ছিল মুলাক্করম। এই করটি স্তনের আকার বা এটির আকর্ষণীয়তার ওপর ভিত্তি করে ছিল না, যেভাবে নাঙ্গেলির এই নতুন কাহিনির গল্পকাররা দাবী করেন, বরং এটি বাধা একটি কর যা বরাদ্দ ছিল একটি পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য, কোনো সন্দেহ নেই খুবই নিপীড়নমূলক একটি কর, কিন্তু এটি খুব সাধারণ একটি কর।
যখন নাঙ্গেলি প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন তিনি নির্যাতনমূলক একটি কর পদ্ধতির দ্বারা সৃষ্ট চরম দারিদ্রে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ছিলেন। এটি ছিল সামাজিক কাঠামো ও পদ্ধতির অন্যায় অবিচারের প্রতি নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণাক্লিষ্ট একটি প্রতিবাদের বার্তা। তিনি শালীনতা বা সন্মান উদযাপন করতে আহবান জানাননি। এটি ছিল জাতপ্রথা এবং পচনশীল সামন্ততান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে একটি সতর্কবার্তা যা সমাজের অসহায় শ্রেণীকে নির্যাতন করছে, যারা এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। তিনি ছিলেন বীরাঙ্গনা, যারা দরিদ্র এবং দুর্বল, তিনি অবশ্যই বর্তমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীসূলভ সন্মানের আদিরূপের প্রতীক নন, যা তাকে এখন বানানো হয়েছে। কিন্তু তারা নাঙ্গেলির বিসর্জনকে স্বীকার করতে পারেন না, কারণ এটি ছিল এই পদ্ধতির প্রতি একটি চূড়ান্ত বার্তা। সুতরাং তারা তাকে পূণ্যবতী দেবি হিসেবে নতুন ছাঁচে উপস্থাপন করেছিল, যিনি তার স্তন ঢাকতে চেয়েছিলেন শুধু, উপেক্ষা করা হয়েছে সেই বাস্তব সত্যটি যে, তিনি ক্ষমতার প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। তার বিদ্রোহী এই প্রাণশক্তি সমাহিত করা হয়েছে, এবং নাঙ্গেলির বিসর্জনকে হ্রাস করা হয়েছে তার একজোড়া স্তনের যোগফলে।
নোট:
নাঙ্গেলির অস্তিত্ব আছে এজহাভা লোককথায়, এছাড়া সমান্তরাল একটি কাহিনি আছে এক আদিবাসী দম্পতির, যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কেরালার অন্য একটি এলাকা থেকে। সম্প্রতি একটি বিতর্ক উঠেছিল নাঙ্গেলির বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে লেখ্য কোনো প্রমাণে অভাব নিয়ে। তবে ভারতে এই ধরনের তথ্য সংরক্ষণ বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ উচ্চবর্ণের জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, যখন নিম্ন বর্ণের বীর বীরাঙ্গনারা শুধুমাত্র গান আর লোককথায় তাদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন, যা প্রায় সবই এখন তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে লিখিত দলিলের অভাব বিবেচনায় এই ধরনের লোককাহিনিকে বাতিল করে দেয়া উচিত হবে না, শুধুমাত্র তাদের গল্পের কোনো লিখিত দলিল নেই এমন দাবী করে, এর বিপরীত, যখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রসঙ্গ আসে, তাদের এইসব গান ও কাহিনিগুলো প্রায়শই তথ্যের একমাত্র উৎস, এগুলো নিয়ে ইতিহাসবিদদের যথাসম্ভব কাজ করতে হবে।
তথ্যসূত্র :
Manu S. Pillai, The Courtesan, the Mahatma & the Italian Brahmin: Tales from Indian History.
Manu S. Pillai, The Ivory Throne: Chronicles of the House of Travancore