দর্শনের সহজ পাঠ: লিও তলস্তয়

leon_tolstoy

(অ্যালান দো বোতোঁ’র একটি লেখা অবলম্বনে কাজী মাহবুব হাসান)

লিও তলস্তয় বিশ্বাস করতেন উপন্যাসের কাজ শুধু আনন্দ দেওয়া নয় বরং এটি মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা আর সংস্কার করারও একটি উপকরণ। তার দৃষ্টিতে এটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম, যার মাধ্যমে আমরা পরস্পরকে চিনতে পারি, বিশেষ করে সেই সব মানুষগুলো, যাদের বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে অনাকর্ষণীয়, আর এভাবেই আমরা সম্প্রসারিত করতে পারি আমাদের মানবতা আর সহিষ্ণুতাকে। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ইয়াসনা পলিয়ানায় তার জন্ম হয়েছিল, এটাই ছিল তাদের পারিবারিক বাসভবন, রাশিয়ার মস্কো থেকে যার অবস্থান প্রায় শত মাইল দক্ষিণে। এখানেই কিছু সংক্ষিপ্ত বিরতিসহ তিনি তাঁর বাকী জীবনটি কাটিয়েছিলেন। জীবনের শুরুর দিকে তিনি কিছু বছর নষ্ট করেছিলেন জুয়া খেলে, মদের নেশা করে আর জিপসী রমনীদের জয় করে, তবে সেই সব কিছুর বিরতি হয় যখন ক্রিমিয়ার যুদ্ধে গোলন্দাজ অফিসার হিসাবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তার তিরিশ বছর পার হবার কিছু দিনের মধ্যে তিনি বিয়ে করেন, তার স্ত্রীর নাম ছিল সোফিয়া, বেশ শিক্ষিত, অভিজাত, সংস্কৃতিবান পরিবার থেকেই তিনি এসেছিলেন, বিয়ের সময় সোফিয়ার বয়স ছিল আঠারো। দুজনে মোট তেরোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে নয় জন বেঁচেছিলেন তাদের শৈশব অতিক্রম করে। খুব সুখের ছিল না বিয়েটা, উভয় পাশে বিতর্ক আর টানাপোড়েন ছিল অনেক।

তলস্তয় একসময় লম্বা দাড়ি রাখতে শুরু করেছিলেন, শরীর সুস্থ্য রাখার নানা কসরত আর স্টাডিতে বেশীর ভাগ সময় কাটাতেন। আর সেটা করতে গিয়েই তিনি বেশ কিছু অত্যন্ত সফল উপন্যাস লিখেছিলেন, যাদের মধ্যে বিখ্যাত তিনটি বই, ওয়ার অ্যাণ্ড পিস, আনা কারেনিনা, এবং দ্য ডেথ অব ইভান ইলিচ। শিল্পের জন্যই শুধু শিল্প, এমন ধারণায় তলস্তয়ের বিশ্বাস ছিল না। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন কোনো ভালো শিল্পকলার উচিৎ আমাদের কম নৈতিকতাবাদী বিচারিক মানসিকতা সম্পন্ন বা জাজমেন্টাল করে তোলা। আর এটি ধর্মের একটি সংযুক্তি হওয়া উচিৎ, যা আমাদের নৈতিকতা আর দয়াশীলতার একটি মজুদ গড়ে তুলবে। আর তলস্তয়ের এই এই উদ্দেশ্যপূর্ণ যোদ্ধা সদৃশ নীতিবাদী দিকটি প্রায়শই সমালোচকরা উপেক্ষা করেছেন, বিশেষ করে আধুনিক সমালোচকরা, কারণ তারা কোনো উদ্দেশ্য আরোপ করে শিল্পকলাকে নোংরা করতে চাননি। কিন্তু বাস্তবিকভাবেই এটাই তলস্তয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর তার কোনো কাজকেই বোঝা সম্ভব হবে না সেটি যদি আমরা মনে না রাখি।

তলস্তয়ের প্রথম মহান উপন্যাসটি ছিল ওয়ার অ্যাণ্ড পিস, ১৮৬৯ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল, যখন তার বয়স ৪১। এখানে আমাদের সাথে দেখা হয় নাতাশা রোস্তভের সাথে, চমৎকার, স্বাধীনচেতা এক তরুণী। শুরুতে নাতাশা ছিল আন্দ্রের বাগদত্তা, একজন দয়ালু আর সৎ মানুষ আন্দ্রে, খানিকটা অন্তর্মূখী, সংযত আবেগী, ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলা আন্দ্রে নাতাশাকেও আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন কিন্তু একই সাথে। যখন আন্দ্রে ইতালীতে, নাতাশার সাথে পরিচয় হয়, সুদর্শন আনাতোলির, কুস্তিগীর, নৈরাশ্যবাদী আনাতোলির প্রেমে খুব সহজে মোহাবিষ্ট হয় তরুণী নাতাশা। সে প্রায় সফল হয়েছিল নাতাশাকে পটিয়ে তার সাথে পালিয়ে যাবার জন্য প্ররোচিত করতে। যদিও এই ভয়ঙ্কর ফাদে পা ফেলার আগে নাতাশাকে রক্ষা করেছিল তার পরিবার। তবে নাতাশার এমন আচরণে সবাই হতবাক আর ক্ষুদ্ধ হয়েছিল, এই ধরনের আচরণ শুধু তার নিজের ক্ষতিরই কারণ হতো না, পুরো পরিবারের জন্যও হতো লজ্জার। পৃথিবীর মাণদণ্ডে, নাতাশা খুবই বাজে একটি ব্যর্থতার উদহারণ, যদি এ ধরনের কোনো কিছু আমরা কোনো খবরের কাগজে পড়তাম, আমরা খুব দ্রুত উপসংহারে পৌছাতাম যে এমন মানুষের কোনো ধরনের সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্যতা নেই। তার কোনো কিছুরই অভাব ছিল না, কিন্তু শুধুমাত্র নিজের কথা ছাড়া সে আর কিছুই ভাবেনি, এবং তার পরিণতির জন্য কেবল সে নিজেই দায়ী।

কিন্তু তারপরও তলস্তয়ের ‍দেখিয়েছিলেন যে যদি আমার নাতাশার মনের ভিতরের দৃশ্যটি দেখতে ও অনুধাবন করতে পারি, আমরা আসলেই আমাদের সহানুভূতি প্রত্যাহার করতে পারবো না ও করবো না। সতিক্যারভাবে সে অসংযত আত্মপ্রশ্রয়ী, লঘুচিত্ত কিংবা পুরোপুরিভাবে বিশ্বস্ততার কোনো ঘাটতিও ছিল না তার মধ্যে। নাতাশা শুধুমাত্র যৌন বিষয়ে অনভিজ্ঞ এক তরুণী, যে তার ব্যস্ত প্রেমিক তাকে অবহেলা করছে এমন অনুভব করেছিল।খুব বেশী আবেগপ্রবণ যার উষ্ণ অনুভূতির তরুণী নাতাশা খুব সহজে আনন্দ ও সূখের প্রতিশ্রুতিতে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু একই সাথে গভীরভাবে তাকে যে দুশ্চিন্তা দূর্বল করে দিয়েছিল, সেটি হচ্ছে সে কাছের মানুষকে হতাশ করছে, আর সেটাই কারণ ছিল ধূর্ত আনাতোলির প্রলোভন আর পরিকল্পনার ফাদে পা দেবার জন্য। তলস্তয় আমাদের নাতাশার পক্ষেই ধরে রেখেছিলেন আর সেটি করার মাধ্যমে, তিনি আমাদের একটি আচরণ অনুশীলন করিয়েছিলেন যা তিনি মনে করতেন একটি নৈতিকতাপূর্ণ জীবনের জন্য মৌলিক আচরণ: আমরা যদি আরো বেশী সতর্ক আর নির্ভুলভাবে অন্য মানুষদের অন্তর জীবনটি লক্ষ্য করতে পারি, তাদের আর খুব সাধারণ, শীতল আর এক- মাত্রিক মনে হবে না, আর আমরা তাদের প্রতি সেই দয়াশীলতা নিয়ে আচরণ করতে পারে যার দাবী তারা করতে পারে ও তাদের প্রয়োজনীয়তাও আছে। সহমর্মিতা আর দয়াশীলতা সবার জন্য, কেউ এই চক্রের বাইরে নয়।

তলস্তয় মনে করতেন উপন্যাসের একটি সুনির্দিষ্ট কাজ হচ্ছে তথা কথিত ঘৃণ্য অপছন্দের চরিত্রগুলোকে আমাদের বুঝতে সহায়তা করা। যেমন আনা কারেনিনা উপন্যাসের শুরুতে একটি অনাকর্ষণীয় চরিত্র ছিল আনার কারেনিনার স্বামী, সেই দাম্ভিক, অনমনীয় কারেনিন। উপন্যাসটি, একটি ট্রাজেডী, যেখানে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, প্রাণবন্ত আর খুবই ‍উদার বিবাহিত আনাকে আমরা দেখি, তার জীবনের স্বাভাবিকতায় ছেদ পড়ে যখন আনা, ভ্রনস্কি নামের সূদর্শন তরুণ এক সামরিক অফিসারের প্রেমে পড়ে যায়। আনার স্বামী – কাউন্ট আলেক্সেই আলেক্সান্দ্রোভিচ কারেনিন – খুবই খুঁতখুতে, তার সামাজিক অবস্থানের ব্যপারে সচেতন, আচরণে উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের মত, যিনি প্রায়শই আনার প্রতি অসংবেদনশীল, এবং তার আবেগীয় চাহিদার কোনো কিছুই উত্তর দেবার মত ক্ষমতা তার ছিল না। ভ্রনস্কির সাথে আনার প্রেম যখন চলমান, তার স্বামীর প্রধান চিন্তা ছিল এটি সামাজিক কুৎসার জন্ম দেবে যা তার সামজিক অবস্থানকে খাটো করবে। বিয়ে বা আনার প্রতি তার বিশেষ কোনো অনুভূতি ছিল না। তাকে আমাদের শীতল আর পশুর মতই মনে হতে পারে। এরপর আনার তার প্রেমিকের সন্তানের জন্ম দেয়, সে অসুস্থ এবং খুব হৃদয় স্পর্শী একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, কারেনিন গভীর ভাবাবেগে আক্রান্ত, সদ্যজাত শিশুটি ও মায়ের জন্য সে কাঁদে ও আনাকে সে ক্ষমা করে দেয়: ‘না, তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারো না ( আনা বলে)। কিন্তু তারপরেও সে হঠাৎ করেই তীব্র আনন্দময় আধ্যাত্মিক একটি অনুভূতি অনুভব করে, যা একই সাথে তাকে দেয় নতুন সুখ, যার সাথে তার কোনোদিনও পরিচয় ছিল না: তার শত্রুদের ভালোবাসা আর ক্ষমাশীলতার একটি আনন্দময় অনুভূতি তার হৃদয় পূর্ণ করেছিল। হাটু মুড়ে বসে, আনার হাতের খাজে মাথা রেখে, সে শিশুর মত কেঁদেছিল’।

এ অবধি শীতল অনুভূতিহীন কারেনিন আনার শিশুর প্রেমে পড়ে:ছোট সদ্যজাত শিশুটির প্রতি সে সম্পূর্ণ অদ্ভুত একটি অনুভূতি অনুভব করে, শুধুমাত্র করুণা নয় সেটি, কোমল স্নেহেরও। প্রথমেই, শুধুমাত্র সহানুভূতির একটি অনুভূতি থেকেই সে আগ্রহী হয়েছিল সেই ক্ষুদ্র নাজুক প্রাণিটির জন্য, কিন্তু এখন দিনের মধ্যে সে বেশ কয়েকবারই শিশুটির ঘরে তাকে দেখতে যায়। কখনো প্রায় আধা ঘন্টা ধরে সে সে নীরবে বসে এক দৃষ্টিতে সে ঘুমন্ত শিশুটির কোমল বিস্মিত মুখ, তার কুচকানো ভ্রূর অস্থিরতা, আঙ্গুলগুলো শক্ত করে মুঠো করে রাখা তার মোটা ছোট হাতগুলো তার ছোট চোখগুলো আর নাক ঘষতে দেখে। বিচক্ষণ তলস্তয়ের কারণে, আমরা পুরোপুরিভাবে অপ্রত্যাশিত একটি দিক দেখি মানুষটির, তার আভ্যন্তরীন জীবন অবশ্যই আমরা এমন প্রত্যাশা করিনি, যখন বাইরে থেকে তাকে আমরা বিচার করেছিলাম। কিন্তু তলস্তয়ের বক্তব্যটি ছিল যে কারেনিন আসলে এই ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত কোনো চরিত্র নয়। তিনি শুধুমাত্র খারাপ আর ভালোর একটি সাধারণ মিশ্রণ। এবং আসলেই খুব স্বাভাবিক যে বরং অপ্রীতিকর মানুষদের গভীরে লুকানো কোমলতার একটি বিশাল ভাণ্ডার থাকে: তাদের চরিত্রের এমন কিছু মাত্রা থাকে, যা খুবই ভিন্ন এবং প্রায়শই যা সুন্দর, তাদের বাইরের চেহারা যা ইঙ্গিত দেয় তার চেয়ে।

প্রায় সমতুল্য আরেকটি অভিযানে আমরা সঙ্গী হই তার আরেকটি চরিত্রের সাথে, ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত The Death of Ivan Illych এর নায়ক – ইভান ইলিচ। উপন্যাসটির শুরুতে আমরা ইভান ইলিচকে দেখতে পাই, একটি উচ্চ আদালতের বিচারক, একটি অগ্রসর সমাজে, যা দেখতে মনে হয় স্বার্থপর, দাম্ভিক আর নৈরাশ্যবাদী। কিন্তু একদিন, জানালায় পর্দা লাগানোর সময় সাহায্য করতে গিয়ে, ইভান একটি মই থেকে পড়ে যায় এবং তার ভিতরে একটি যন্ত্রণার ব্যপারে প্রথম সে সচেতন হয়, যা সেই ভয়ঙ্কর রোগের প্রথম উপসর্গ, যা পরে প্রাণনাশী ব্যাধি হিসাবে প্রমাণিত হয়। তার জীবনে অবশিষ্ট সময় ছিল মাত্র কয়েক মাস, তার স্বাস্থ্য যখন খারাপ হতে শুরু করে, ইভান ঘরে তার সোফায় বসে দীর্ঘ সময় কাটাতে শুরু করে।তার পরিবারের সদস্যরা, যারা সচেতন তার মৃত্যু কত বড় অসুবিধাজনক তাদের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদার জন্য, তারাও ইভান ও তার অসুখ নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা শুরু করে প্রকাশ্যেই। এছাড়াও ইভানও ছিলেন বদমেজাজী। কিন্তু অভ্যন্তরে, একের পর এক উপলদ্ধি তিনি অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। তার জীবনের অতীতের দিকে তাকিয়ে, এবং এর তুচ্ছতা আর অগভীরতা নিয়ে তিনি অনুশোচনা করেন। প্রকৃতির প্রতি তিনি নতুন করে সংবেদনশীল হয়ে ওঠেন – এবং তার সার্বক্ষনিক পুরুষ গৃহভৃত্যটির সাধারণ দয়াশীলতা তাকে স্পর্শ করতে শুরু করে – খুব সাদামাট কৃষক পরিবারের অশিক্ষিত সেই মানুষটি তাকে মুগ্ধ করে। তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে থাকেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব সত্যটিকে কিভাবে সবাই নির্বোধের মত উপেক্ষা করে যে: আমরা সবাই মারা যাবো। তিনি অনুধাবন করেন যে আমাদের মরণশীলতা সারাক্ষণ আমাদের মনে থাকা উচিৎ, এবং সার্বক্ষনিক দয়া আর সহমর্মিতা উৎস যেন সেটি হয়। যখন তিনি মারা যান, তলস্তয় কল্পনা করেন তিনি অবশেষে তার চারপাশে সবার জন্য করুণা আর ক্ষমা অনুভব করেছিলেন।

তার লেখার বৈশিষ্টসূচক অংশ, তলস্তয় সুবিশাল দার্শনিক আর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে কোনো ছাড় দিতেন না যখন তিনি তার নায়কে মনে সংগঠিত সেই নাটকগুলো বর্ণনা করতেন তার পাঠকদের জন্য। তার চারপাশে সবাই, ডাক্তার ও তার পরিবার, দেখত একটি বিষন্ন চাপা ক্রোধে আক্রান্ত মানুষ, যে তার বেশীর ভাগ সময় কাটায় দেয়ালের দিকে মুখ করে, যে সবসময় বলছে, দূর হয়ে যাও, আমাকে একা থাকতে দাও। যে প্রায়শই তার দূঃখে গর্জন করছে, কিন্তু তারপরও আমরা একটি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা মানুষকে দেখি, যার নৈতিক সাহস অতুলনীয়। ইভানের কথা লেখার মাধ্যমে তলস্তয় আমাদের দেখাতে চেয়েছিলেন তার জীবন মানবীয় সব সম্ভাবনার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, শুধু দেরী না হবার আগে আমাদের সেটি শনাক্ত করতে হবে।

তার বয়স যখন সত্তর, তলস্তয় লেখক হিসাবে তার সব ভাবনাগুলোকে জড়ো করেছিলেন একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে What is art?, এটি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি। এখানেই তলস্তয় প্রস্তাব করেছিলেন, শিল্পকলার একটি মহান উদ্দেশ্য আছে। মহান শিল্পকলার মাধ্যমে, তিনি আমাদের বলেন, নিচু অনুভূতিগুলো – কম দয়াশীল আর মানবতার জন্য কম প্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলো – বের করে দেয়া যেতে পারে জোর করে আর প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে আরো দয়াশীল অনুভূতিগুলো দিয়ে, যা আমাদের জন্য এককভাবে ও সমষ্ঠীগতভাবে কল্যানকর। এটাই শিল্পকলার উদ্দেশ্য। একজন অতি দক্ষ আর পাঠকের মনকে প্ররোচিত করতে পারার ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন, তলস্তয় জানতেন উপন্যাসের প্রয়োজন আছে আনন্দ দেবার অথবা কোনো দরকার নেই সেটি পড়ার। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন তাদের উচিৎ হবে আরো কিছু হবার জন্য, আমাদের নিজেদের প্রাপ্তবয়স্ক ও দয়াশীল হবার বন্ধুর পথে প্রধান সহায়ক হতে হবে। আর তারা সেটি করতে সক্ষম কারণ তারা এমন সব জায়গায় যেতে পারে যেখানে যাওয়া আমাদের প্রয়োজন, কিন্তু কদাচিৎ সেখানে যাবার প্রবেশাধিকার আছে: অন্য মানুষের অন্তর্জীবন। What is art? এ তলস্তয় মূলত অন্য লেখকদের লেখা নিয়ে কথা বলেছিলেন, কিন্তু আসলে এটি তিনি নিজে যা করেছেন, সেই অর্জনটাই, পরোক্ষভাবে, বিনম্রভাবে, তিনি সেই প্রস্তাবনাগুলোই জড়ো করেছিলেন, তিনি বলতেন মহান লেখকদের কখনোই উচিৎ না শুধুমাত্র তার পাঠকদের সময় কাটাতে সাহায্য করা। তাদের লেখা হতে হবে এক ধরনের চিকিৎসার মত বা থেরাপি, মানসিক বিকাশ ও আবেগীয় স্বাস্থ্য ও নৈতিক কাণ্ডজ্ঞান শেখানোর প্রচেষ্টা হতে হবে সেটি।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে লিও ও তার স্ত্রী সোফিয়ার মধ্যে টানাপোড়েনও বাড়তে থাকে, তিনি অভিযোগ করেন যে বেঁচে থাকার অর্থ সম্বন্ধে তাদের দুজনের ধারণা পুরোপুরি বীপরিত। কিন্তু তিনি তার জায়গা ছাড়েননি একটুও, এমনকি যখন সোফিয়া আরো বেশী বিরক্তিকর, স্বৈরাচারী আর নিয়ন্ত্রণহীন হয়েছে। তিনি তারপরও সোফিয়াকে ভালোবাসা অব্যহত রেখেছেন। যদিও তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি নিজের অনুভূতি প্রকাশের সব প্রচেষ্টাই পরিত্যাগ করেছেন, বিবাহের বিছানার মত আর কোনো বড় ট্রাজেডি নেই, তিনি লিখেছিলেন। অবশেষ, যখন তার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, তলস্তয় আর সহ্য করতে পারেননি। নভেম্বরে তীব্র শীতের এক রাতে তিনি তার স্ত্রী ও পরিবারকে পরিত্যাগ করেন। কাছাকাছি একটি ট্রেন স্টেশনের ট্রেনের অপেক্ষা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন।

তলস্তয়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান ছিল, অসংখ্য মানুষ রাশিয়া এবং সারা বিশ্ব থেকে সেখানে জড়ো হয়েছিল। আর সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কারণ তার মূল প্রস্তাবনার সামাজিক প্রভাব ছিল অনেক বিশাল। তিনি অনুধাবন করেছিলেন অন্য মানুষগুলো কেমন সেই বিষয়ে আমাদের ধারণাগুলো, সব সম্পর্ক, অর্থনীতি আর রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী বিভাজনকারী শক্তি। তিনি সেই আকর্ষণীয় ধারণাটি চিরকাল সমর্থন করে গেছেন, শিল্পকলা আরো বেশী সঠিক -এবং আরো বেশী দয়ালু – ধারণা দেয় অন্যদের মনে ( ও জীবনে) কি ঘটছে সেই সম্বন্ধে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ইয়াসনা পলিয়ানায় আর সেখানে বাগানে তার ছোট বেলার পরিচিত গাছের নীচে তাকে সমাহিত করা হয়।

দর্শনের সহজ পাঠ: লিও তলস্তয়

3 thoughts on “দর্শনের সহজ পাঠ: লিও তলস্তয়

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান