হোমিওপ্যাথী: যখন বিশ্বাসে মেলায় বস্তু

(ছবি: কার্টুন , হোমিওপ্যাথীর মুল সুত্র)

If homeopathy works, then obviously the less you use it, the stronger it gets. So the best way to apply homeopathy is to not use it at all. Phil Plait

The findings of currently available Cochrane reviews of studies of homeopathy do not show that homeopathic medicines have effects beyond placebo.  Edzard Ernst

ভুমিকার আগে:

আশা করছি লেখাটি হোমিওপ্যাথী সম্বন্ধে বিজ্ঞান ঘনিষ্ট একটি আলোচনা হবে। কথাটা আগেই বলে নেবার কারন, অনেকের মতই আমার দৃষ্টিতেও হোমিওপ্যাথী একটি অপবিজ্ঞান বা সিউডোসায়েন্স, অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক হিসাবে দাবী করা হলেও যার সত্যিকারের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সুতরাং আলোচনাটা সীমাবদ্ধ থাকবে হোমিওপ্যাথীর মুলনীতি, এই সংক্রান্ত গবেষনাগুলোর ফলাফল ও হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার করা পদ্ধতি বা প্যাটার্ণ এর উপর।

লেখাটির বড় একটি অংশ যেহেতু এডজার্ড আর্ণষ্ট (Edzard Ernst) এর বেশ কিছু গবেষনা পত্র নির্ভর, সেকারনে আর্ণষ্ট এর পরিচয় সম্বন্ধে কিছুটা বলে রাখা প্রয়োজন। জার্মানীতে জন্ম নেয়া আর্ণষ্ট হোমিওপ্যাথী সহ নানা বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত হন এবং তার পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল মিউনিখের একটি হোমিওপ্যাথী হাসপাতালে।পরে ১৯৯৯ সালে তিনি বৃটিশ নাগরিকত্ব গ্রহন করেন, এবং এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয় এর কম্প্লিমেন্টারী মেডিসিনের অধ্যাপক নিযুক্ত নন ( এই বিষয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাই পথম অধ্যাপকের পদ); মোট দুটি মেডিকেল জার্ণাল সম্পাদনার সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন, এছাড়া তার গবেষনা আর লেখার মাধ্যমে তিনি বিকল্প এবং কম্প্লিমেন্টারী মেডিসিন এর নানা দাবী বৈজ্ঞানিক প্রমান নির্ভর চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে ব্যবচ্ছেদ করে আসছেন। তার সমালোচনাপুর্ণ নানা গবেষনা পত্র প্রকাশের পর থেকে বিকল্প চিকিৎসার সমর্থকরা তাকে চিহ্নিত করে ”বিকল্প চিকিৎসার জন্য অভিশাপ” হিসাবে। ২০০৫ এ যখন অর্থনীতিবিদ ক্রিষ্টোফার স্মলউড প্রিন্স চার্লস এর ব্যাক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতায় একটি রিপোর্ট (স্মলউড রিপোট) প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি বৃটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে হোমিওপ্যাথী সহ নানা বিকল্প চিকিৎসাকে যুক্ত করাকে ব্যায়সাশ্রয়ী হিসাবে মতামত দেন। এই বিপোর্টে আর্ণষ্ট সহযোগী হিসাবে থাকলেও তিনি তার নাম প্রত্যাহার করে নেন ড্রাফট রিপোর্টটি পড়ার পর, তিনি দাবী করেন স্মলউড কোন প্রমান বা গবেষনা রিপোর্ট পর্যালোচনা ছাড়াই বিকল্প চিকিৎসাকে সমর্থন দিয়েছেন। এই বিষয়ে পত্রিকায় লেখা তার একটি চিঠি, তাকে বেশ সমস্যায় ফেলে দেয়, এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে একরকম বাধ্য করা হয় পদত্যাগের জন্য, তার গবেষনার সমস্ত অনুদানও প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৮ এ তিনি সিমন সিং কে নিয়ে লেখেন Trick or Treatment? Alternative Medicine on Trial ; সেখানে তারা বৃটিশ সরকারে প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড অপ্রমানিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে অপব্যয় করার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন (বইটি মজা করে উৎসর্গ করা হয়েছে প্রিন্স চার্লস কে); হোমিওপ্যাথী সহ বিকল্প চিকিৎসার নানা দাবীর প্রতি তার সন্দিহান অনুসন্ধান এবং গুরুত্বপুর্ণ সিস্টেম্যাটিক রিভিউগুলো হোমিওপ্যাথী সম্বন্ধে সন্দেহবাদীদের জানার ক্ষেত্রটি প্রসারিত করেছে অনেকটুকু। তার গবেষনাপত্র থেকে একটি উদ্ধৃতি নিয়ে শেষ করি এই অংশটি: If homeopathy is correct, much of physics, chemistry, and pharmacology must be incorrect…. To have an open mind about homeopathy or similarly implausible forms of alternative medicine (eg, Bach flower remedies, spiritual healing, crystal therapy) is therefore not an option. We think that a belief in homeopathy exceeds the tolerance of an open mind.

ভুমিকা:

বিজ্ঞান নির্ভর চিকিৎসার ’বিকল্প’ বা অল্টারনেটিভ চিকিৎসাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি জায়গা দখল করে আছে জনপ্রিয় হোমিওপ্যাথী চিকিৎসা পদ্ধতি। সময়ের হিসাবে চীন বা ভারতের ট্রাডিশনাল চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে হোমিওপ্যাথী বেশ সাম্প্রতিক একটি আবিষ্কার। প্রায় ২০০ বছরের একটু বেশী সময় ধরেই হোমিওপ্যাথী ধীরে বিস্তার লাভ করেছে সারা বিশ্বে। এছাড়া বর্তমান যুগে বিকল্প চিকিৎসা সম্পর্কে গড়ে ওঠা নতুন কৌতুহলের সুফলও হোমিওপ্যাথীকে আরো সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী বিস্তারে। হোমিওপ্যাথী ‘নিরাময়’ গুলো সম্ভবত একমাত্র হাতুড়ে বা কোয়াক দ্রব্য যা আইনগতভাবে বহুদেশেই ঔষধ হিসাবে বিক্রয় হয়। এমনকি ঔষধ নিয়ন্ত্রনের অন্যতম প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন (FDA) হোমিওপ্যাথী ‘নিরাময়’ কে প্রশয় দিয়ে আসছে অন্যান্য ঔষধের ক্ষেত্রে তাদের কঠিন নিয়ম কানুনগুলো শিথিল করে।

ভারতীয় উপমহাদেশে এটি প্রবেশ করেছিল বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে,এক শতাব্দীরও কিছু সময় আগে। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথী চিকিৎসকের সংখ্যা আসলে কত খুজে দেখার প্রচেষ্ঠায় পাওয়া অন্তর্জালের তথ্য বলছে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ টি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল আছে, যার মধ্যে একটি সরকারী। সবগুলো হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ নিয়ন্ত্রন করছে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন ও সার্জারীর স্নাতক ডিগ্রীটি প্রদান করে, এছাড়াও আছে একটি ডিপ্লোমা। যারা আমাদের দেশে হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার সম্বন্ধে খোজ রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানবেন, দুই ধরনেরই হোমিওপ্যাথী চিকিৎসক আছেন, যারা ডিগ্রী প্রাপ্ত বা কোয়ালিফায়েড এবং যাদের কোন ডিগ্রী নেই আনকোয়ালিফায়েড, স্বশিক্ষিত , সাম্প্রতিক একটি গবেষনা বলছে এদের সংখ্যাই বেশী। গবেষনাটি বলছে বাংলাদেশে প্রতি ১০০০০ মানুষের জন্য প্রায় ৬ জন হোমিওপ্যাথী চিকিৎসক আছেন; শহরেই হোমিওপ্যাথী চিকিৎসকের সংখ্যা বেশী (৭/১০০০০), বিশেষ করে খুলনা ( প্রায় ৯/১০০০০), রাজশাহী (প্রায় ৮/১০০০০) এবং সিলেটের ( ৬/১০০০০) শহরাঞ্চলগুলোয়; একটি হোমিওপ্যাথী সংক্রান্ত ওয়েবসাইট এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ হোমিওপ্যাথীর চিকিৎসা গ্রহন করেন। যদিও বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবার প্রবণতার উপর পরিচালিত গবেষনা গুলো হোমিও চিকিৎসাকে অন্যান্য ট্রাডিশনাল চিকিৎসার সাথে শ্রেনীভুক্ত করে দেখিয়েছে, আসলে অ্যালোপ্যাথিক বা সেই সংক্রান্ত আংশিক শিক্ষিত আধা পেশাজীবিরাই বাংলাদেশে মুল চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে, যা বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের অপ্রতুলতার বিষয়টিও ইঙ্গিত করছে। আর্থসামাজিক অবস্থান যেখানে রোগের চিকিৎসা কিভাবে হবে তার একটি অন্যতম প্রধান নিয়ামক, সেখানে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর বিকল্প ’চিকিৎসার’ একটি অংশ প্রদান করে আসছেন যে হোমিওপ্যাথরা সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে তাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির ২৮ তম কৌশলে হোমিওপ্যাথী সহ আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানী, এই তিনটি শাখাকে আরো বৈজ্ঞানিক ( এর অর্থ নীতি নির্ধারকরাই ভালো বলতে পারবেন) করার উপর জোর দিয়ে পদ্ধতিগুলোকে জাতীয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

কিছু সুনির্দিষ্ট কারনেই বৈজ্ঞানিক হিসাবে দাবী করা চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে হোমিওপ্যাথী অন্যতম বিতর্কিত।হোমিওপ্যাথী নিয়ে বিভিন্ন গবেষনার সিস্টেম্যাটিক বা পদ্ধতিগত বিশ্লেষন এখনও পর্যন্ত হোমিওপ্যাথী রেমেডি বা চিকিৎসার ‍কার্যকারীতা প্রমান করতে ব্যর্থ হয়েছে; নির্দিষ্টভাবেই দেখা গেছে কোন অসুখের চিকিৎসা হিসাবে হোমিও ঔষধগুলো, পরিক্ষীত অন্য কোন ঔষধ এবং প্ল্যাসিবো ( প্ল্যাসিবো বা ঔষধকল্প আসলে কোন ঔষধ না, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যা এক গ্রুপ রোগীদের, সাধারনত র্যা নডোম ভাবে নির্বাচন করে, যা দেয়া হয় ঔষধের বিকল্প হিসাবে, রোগীদের এবং কখনো কখনো গবেষকদেরও যা জানানো হয় না, যেমন ডাবল ব্লাইন্ড স্টাডি) থেকে কোন ভাবেই বেশী কার্যকর না। এবং প্রকাশিত সব গবেষনার মেটা অ্যানালাইসিসগুলোতেও দেখা যাচ্ছে, কোন হোমিও ঔষধই প্ল্যাসিবো বা ঔষধকল্প থেকে রোগীর শরীরে সুস্পষ্ট বা ভিন্ন কোন ক্লিনিক্যাল ফলাফল সৃষ্টি করতে পারেনা, যা কিনা প্রমান করা সম্ভব।

অবশ্যই তবে রোগীদের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর যদি আপনি বিশ্বাস রাখতে পারেন, তাহলে সন্দেহ নেই বিশাল সংখ্যক মানুষ, অত্যন্ত নিশ্চয়তার সাথে দাবী করবেন, তারা হোমিওপ্যাথী চিকিৎসায় হয় সুস্থ হয়েছেন, নয়তো উপকার পেয়েছেন, প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় যখন তারা উপকৃত হননি।

তাহলে হোমিওপ্যাথী কি আসলেই কাজ করে?

প্রশ্নটাতে আবার ফিরে আসবো, তার আগে এই উপকারী বলে দাবী করা চিকিৎসা পদ্ধতিটা আসলে কি, সেটা আলোচনা করা যাক।

হোমিওপ্যাথীর উদ্ভব এবং স্যামুয়েল হ্যানিমান:

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে হোমিওপ্যাথী পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছিলেন একজন জার্মান চিকিৎসক, স্যামুয়েল হ্যানিমান (Christian Friedrich Samuel Hahnemann :১৭৫৫-১৮৪৩ ); হ্যানিম্যান এর জন্ম ‍এবং বেড়ে ওঠা জার্মানীর মেইসেন (Meissen) শহরে। প্রথমে লাইপজিগ, এরপর ভিয়েনা হয়ে,১৭৭৯ সালে এরলাঙগেন (Erlangen) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতক হন। চিকিৎসক হিসাবে পেশাগত জীবনের প্রথম ১৫ বছর অর্থনৈতিকভাবে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছিল তাকে, তবে ১৮৪৩ সালে ৮৮ বছর বয়সে প্যারিসেএকজন অত্যন্ত্য ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসাবে তিনি মৃত্যুবরন করেন।

হ্যানিমানের সমসাময়িক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো মুলত: শরীরের নানা তরল পদার্থর (হিউমর বা Humor, ল্যাটিন এই শব্দের অর্থ তরল) ভারসাম্য রক্ষা করার মাধ্যমে অসুস্থতার চিকিৎসা করার উপর নির্ভরশীল ছিল; সুস্থতা ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু কৌশল প্রয়োগ করা হতো সেসময়, যেমন শিরা কেটে নিয়ন্ত্রিত রক্তপাত (Venesection বা blood letting), রক্ত শোষক জোক ( যেমন Hirudo medicinalis) ব্যবহার (leeching), গরম ক্যাপ ব্যবহার করে চামড়ায় ফোসকা সৃষ্টি করা (Blistering) কিংবা খুবই বিষাক্ত ঔষধ, যাদের মধ্যে প্রায় পারদ বা মার্কারী থাকতো, ব্যবহার করে রোগীর শরীরে ঘাম, অত্যাধিক লালা সৃষ্টি করা বা জোরপুর্বক বমি, ডায়রিয়ার (purging) উদ্রেক করা ইত্যাদি। যা প্রায়শই রোগীদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশী করতো।

হ্যানিমান তার পেশাগত জীবনে শুরুতে লক্ষ্য করেছিলেন, রোগীদের আসলে এধরনের কোন চিকিৎসা দেবার চাইতে, না দিলেই প্রায়ই ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। ৩৫ বছর বয়সেই হ্যানিম্যান প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পেশা ত্যাগ করেন এবং সংসার চালানোর জন্য বেছে নেন নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যর মিশ্রন প্রস্তুত আর অনুবাদ করার করার কাজে। বহু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন হ্যানিমান। কথিত আছে ১৭৯০ সালে বিখ্যাত স্কটিশ চিকিৎসক উইলিয়াম কালেন এর একটি ভেষজ চিকিৎসার বই, ইংরেজী থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করার সময় কালেন এর একটি মন্তব্য হঠাৎ তার নজরে পড়ে। কালেন বলছিলেন, Cinchona বা সিনকোনা গাছ (China officalis) এর বাকল থেকে প্রস্তুত দ্রবণটি ম্যালেরিয়া নিরাময় করতে পারে কারন এটির তিক্ততা (পরবর্তীতে আমরা জেনেছি যে, সিনকোনা বাকলে আসলে একটি অ্যালকালয়েড থাকে, যার মুল উপাদান কুইনিন; ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় যার এখনও প্রচলন আছে ); হ্যানিমানের কাছে ব্যাপারটা প্রথমে অযৌক্তিক মনে হয়, কারন অন্য কোন তিক্ত স্বাদযুক্ত কিছু তো সেভাবে ম্যালেরিয়া নিরাময় করতে পারছে না।

মুলত: কৌতুহল বশেই হ্যানিম্যান নিজেই বেশ কয়েক ডোজ সিনকোনা গ্রহন করেন, উদ্দেশ্য সুস্থ শরীরে এটি কি ধরনের প্রভাব ফেলে সেটি লক্ষ্য করা। তিনি যা লক্ষ্য করেন তা হলো: সুস্থ শরীরে সিনকোনা ঠিক ম্যালেরিয়ার মতই রোগ সৃষ্টি করে, তবে যা মুল ম্যালেরিয়া রোগ থেকে বেশ মৃদু, ম্যালেরিয়ার সেই কাপুনী দিয়ে জ্বর আসার ব্যপারটা সেখানে ঘটছে না। আর হ্যানিম্যান ঠিক এখান থেকে তার বিখ্যাত ধারনাটি পেয়ে যান।

হ্যানিম্যান এর মতে, সিনকোনা ম্যালেরিয়া নিরাময়ে কার্যকর তার কারন হচ্ছে এটি যে রোগ নিরাময় করছে ঠিক সেই রোগের মতই এটি সুস্থ্য শরীরে উপসর্গ সৃষ্টি করতে সক্ষম। উৎসাহিত হ্যানিম্যান এরপর ধীরে ধীরে আরো বেশ কিছু ঔষধ এবং রাসায়নিক পদার্থ একইভাবে নিজের উপর পরীক্ষা করে দেখেন এবং সুস্থ শরীরে তাদের প্রভাব লক্ষ্য করেন, কি ধরনের উপসর্গ তারা তৈরী করছে, এবং একই ধরনের উপসর্গ যুক্ত রোগের নিরাময়ে তারা কতটুকু কার্যকরী । নিজের সাফল্যে আত্মবিশ্বাসী হয়ে তিনি তার Laws of Similar বা সদৃশ্যতার সুত্রটি প্রণয়ন করেন তার প্রস্তাবিক রোগ নিরাময় পদ্ধতির জন্য সাধারন একটি মুলনীতি হিসাবে। সেই ধারনাটি ১৭৯৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন Essay on a New Principle for Ascertaining the Curative Power of Drugs শীর্ষক একটি নিবন্ধে; এখানে তিনি তার প্রস্তাবিত চিকিৎসা পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা দেন; তিনি যার নাম করন করেন Homeopathy (হোমিওপ্যাথী)।

মুলধারার চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে হোমিওপ্যাথীর প্রথম মৌলিক পার্থক্যটি হচ্ছে, এটি এমন একটা চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতিনিধিত্ব করছে, যা দাবী করছে: কোন অসুখের জন্য সবচেয়ে উত্তম চিকিৎসা হবে সেই ঔষধটি, যা কিনা কোন সুস্থ মানুষের শরীরের সেই রোগের মত একই ধরনের উপসর্গগুলো সৃষ্টি করে। সেজন্য হ্যানিম্যান এর নামকরন করেছিলেন হোমিওপ্যাথী (হোমিওপ্যাথী শব্দটার উৎস দুটি গ্রীক শব্দ; hómoios, যার অর্থ সদৃশ বা একই রকম বা “like” এবং páthos যার অর্থ কষ্ট বা অসুখ বা Suffering)। এখানে বলে রাখা ভালো অ্যালোপাথী (Allopathy), যা প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির আরেকটি নাম, সেটিও হ্যানিমানের দেয়া।

১৮১০ সালে প্রকাশিত হয় তার সবচেয়ে বিখ্যাত রচনাটি, The Organon of The Healing Art , যে বইটি এখনও হোমিওপ্যাথী শিক্ষার মুল ভিত্তি। সেই সময়ের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন নিয়ন্ত্রিত রক্তপাত, জোক দিয়ে রক্ত শোষন ইত্যাদির চেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি হিসাবে হোমিওপ্যাথী আকর্ষন করেছিল বহু চিকিৎসককে । ১৭৯৭ সালে চিকিৎসা পেশায় আবার ফিরে আসেন হ্যানিম্যান, তবে একজন হোমিওপ্যাথ হিসাবে।

এবার হোমিওপ্যাথীর মুলনীতিগুলোর একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া যাক:

সদৃশ্যতার সুত্র বা The law or Principle of Similarity বা like cures like:

আগের অনুচ্ছেদে যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, হ্যানিম্যান বিশ্বাস করতেন, কোন একটি রোগীর অসুখ সারানো যাবে এমন কোন ঔষধ দিয়ে, যদি কোন সুস্থ মানুষকে সেটি খাওয়ানো যায়, তবে ঔষধটি সেই একই অসুখের মতই মৃদু অসুস্থতার কারন হবে। যেমন, যদি কোন রোগীর অসুখ হয় তীব্র বমি বমি ভাব,তাকে এমন একটি ঔষধ দেয়া হবে, যা কোন সুস্থ মানুষ সেবন করলে মৃদু বমি বমি ভাব হবে। এছাড়া যেমন আর্সেনিক সুস্থ মানুষের শ্বাসকষ্ট করতে পারে, এজন্য শ্বাসকষ্টের চিকিৎসার জন্য আর্সেনিক ব্যবহার করা যেতে পারে।হ্যানিম্যান এভাবে একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরী করেছিলেন বিভিন্ন ধরনের পদার্থ ব্যবহার করে, যা তিনি দাবী করেছেন নানা অসুখের কার্যকরী চিকিৎসা হিসাবে। তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী রোগীর অসুখের উপসর্গের সাথে, কোন ঔষধের সৃষ্ট উপসর্গ মিলিয়ে চিকিৎসার জন্য কার্যকরী ঔষধ দিতে হবে। এভাবে জন্ম হয়েছিল বিখ্যাত প্রবচনটি Like cures like বা পরিচিত law বা Principle of Similarity হিসাবে। তিনি উদহারন হিসাবে এখানে এডওয়ার্ড জেনারের গরুর বসন্ত (কাউ পক্স) ব্যবহার করে গুটি বসন্তের চিকিৎসার উদহারন দিয়েছিলেন। অবশ্য হ্যানিমানের সে সময় রোগজীবানু কিংবা ইমিউনিটি বা আমাদের রোগপ্রতিরোধ সংক্রান্ত কোন ধারনা থাকার কথা না।

হ্যানিমান এর মতে, শরীরের নিজস্ব নিরাময় শক্তির কোন অস্থিতিশীলতাকে প্রতিনিধিত্ব করছে কোন অসুখ এবং শুধু সামান্য একটি স্টিমুলাস বা প্রনোদনা প্রয়োজন এই নিজস্ব নিরাময় শক্তির প্রক্রিয়াটিকে শুরু করার জন্য। পরবর্তীতে তিনি নানা ধরনের ঔষধ ( এছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, খনিজ, ভেষজ পদার্থ) সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে তাদের শরীরে এই ঔষধগুলো কি ধরনের উপসর্গ সৃষ্টি করে তা রেকর্ড করেছিলেন, যে প্রক্রিয়াকে তিনি বলতেন Proving (মুল জার্মান শব্দ Prüfung, যার অর্থ test), আধুনিক হোমিওপ্যাথরা যা বলেন Human pathogenic trial;

হোমিওপ্যাথিক Proving হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে হোমিও ঔষধের প্রোফাইল নির্ধারন করা হয়ে থাকে। এই পক্রিয়ায় একজন সুস্থ মানুষ কোন একটি নির্দিষ্ট পরীক্ষাধীন পদার্থের খুব সামান্য পরিমান সেবন করেন, এবং তারপর এই পদার্থটির কারনে হওয়া সকল উপসর্গ এবং শারীরিক এবং মানসিক সব প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করা হয়। এভাবে হ্যানিমান ও তার অনুসারীরা কোন অসুখের জন্য কোন চিকিৎসা ভালো কাজ করবে তা প্রমান করেছেন বলে দাবী করেন। হ্যানিমান এবং তার অনুসারীরা এভাবে প্রায় ১০০ র উপর নানা পদার্থ নিজেদের উপর পরীক্ষা করেছিলেন। যদিও এভাবে কোন ঔষধের কার্য্যকারীতা পরীক্ষা করা আসলেই ব্যাখ্যাতীত এবং সে কারনেই অবশ্যই তর্কের উর্ধে না। এরপর হ্যানিমান চেষ্টা করেন অসুস্থ রোগীদের উপসর্গের সাথে এই সব ঔষধের সৃষ্ট উপসর্গগুলো মিলিয়ে সেই অসুখের চিকিৎসা বা রেমেডি হিসাবে প্রস্তাব করতে। এভাবে proving এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা অভিজ্ঞতাগুলো দিয়েই হ্যানিমান পরবর্তীতে ম্যাটেরিয়া মেডিকা বা হোমিও ফার্মাকোপিয়ার ভিত্তি রচনা করেছিলেন।

এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, হোমিও ফার্মাকোপিয়ায় তালিকাভুক্ত ঔষধগুলো কোন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়নি, এটি করা হয়েছে ‘প্রুভিং’ এর মাধ্যমে, যার বেশীর ভাগই সম্পাদিত হয়েছে এক শতাব্দীর বেশী সময় আগে। স্পষ্টতই এই প্রুভিং প্রক্রিয়াগুলো কোন আদর্শ উপায়ে করা হয়নি এবং প্রক্রিয়াগতভাবে দুটি একই পদার্থর প্রুভিং প্রক্রিয়ারও পারস্পরিক মিলও তেমন ছিল না প্রায় সব ক্ষেত্রেই। কারন একজন হোমিওপ্যাথ থেকে অন্য হোমিওপ্যাথ এর করা এই প্রুভিং গুলোর মধ্যে পার্থক্য ছিল: যেমন ডোজের পার্থক্য, কতদিন ধরে তা খাওয়া হয়েছে তার পার্থক্য, এবং এছাড়া পদার্থটির ঘনত্বের নানা তারতম্যতো ছিলই। বইটির সাম্প্রতিক সংস্করনে এক হাজারের বেশী এধরনের প্রুভিং এর মাধ্যমে নির্বাচিত ঔষধের বিবরণ আছে। ঠিক কোন অসুখ বা উপসর্গের জন্য কোন ঔষধটি ব্যবহার করতে হবে সেটা এখানে কিন্তু লেখা নেই। এটা নির্ভর করে হোমিও চিকিৎসক বা এর প্রস্তুতকারকের উপর। সুতরাং হোমিওপ্যাথী এই চিকিৎসাগুলো ঔষধ বলে দাবী করা হলে, এদের ঔষধ বলে স্বীকৃতি দেবার জন্য আসলে কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।

মিয়াজমা তত্ত্ব :

১৮২৮ সালে হ্যানিমান মিয়াজম বা Miasm বা Miasma ( শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক, যার অর্থ দুষন বা দুষিত করা) ধারনাটি প্রস্তাব করেন অনেক পরিচিত রোগের মুল কারন হিসাবে। হোমিওপ্যাথীতে মিয়াজমা হচ্ছে আমাদের মুল প্রান শক্তি বা Vital force এর অসুস্থতার কারন । হ্যানিমান নির্দিষ্ট অসুখের সাথে মিয়াজম এর কারন যুক্ত করেন, এবং একই মিয়াজমকে চিহ্নিত করেন নানা রোগের কারন হিসাবে। হ্যানিম্যানের মতে, প্রায় সকল দীর্ঘ মেয়াদী অসুখের কারন হচ্ছে মিয়াজমা। তার মতে প্রথম যখন মিয়াজমার মুখোমুখি হয় আমাদের শরীর, এটি স্থানীয় উপসর্গ, যেমন চর্ম রোগ বা যৌন রোগ সৃষ্টি করে। এবং এই উপসর্গগুলো যদি ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয় চেপে রাখার জন্য যেমনটা প্রচলিত চিকিৎসায় করা হয়, তবে তা ব্যর্থ হবে, কারন এটি টিকে থাকবে শরীরের গভীরে, দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা হিসাবে। এবং সেই গভীর অসুখটাকে আগে চিকিৎসা করতে হবে, আমাদের ভাইটাল ফোর্সকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রাথমিক ভাবে হ্যানিম্যান তিনটি মিয়াজমার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান হলো Psora বা সোরা, (গ্রীক শব্দ যার অর্থ চুলকানী)। যা অনেক রোগের কারন হিসাবে তিনি বিশ্বাস করতেন, যেমন মৃগীরোগ, ক্যান্সার, জন্ডিস ইত্যাদি।

হ্যানিমানের উত্তরসুরীরা পরবর্তীতে আরো মিয়াজমার প্রস্তাব করেছেন, এমনকি যখন রোগ সৃষ্টির কারন সম্বন্ধে বিজ্ঞান বেশ কিছুটা অগ্রসর হয়েছিল। তাই আপাতদৃষ্টিতে হ্যানিমান প্রবর্তিত চিকিৎসা পদ্ধতি খুব আধুনিক মনে হতে পারে, যেমন রোগী অনুযায়ী রোগের জন্য সঠিক ঔষধটি খুজে বের করে চিকিৎসা দেয়া, কিন্তু তার চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে উপসর্গগুলোর বৈশিষ্ট অনুযায়ী চিকিৎসা করার একটি চেষ্টা, কিন্তু যে মুল অসুখের কারনে উপসর্গগুলো হচ্ছে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয় না। এই বিষয়টির মধ্যে হোমিওপ্যাথীর মুলতেত্ত্বের সাথে একটি স্ববিরোধিতা স্পষ্ট।

ক্ষুদ্রতম মাত্রা ও অ্যাভোগাড্রোর সংখ্যা:

প্রথম দিকে প্রুভিং এর সময় প্রচলিত ঔষধের অল্পমাত্রার ডোজ সেবন করলে, পরবর্তীতে হ্যানিমান সেই সব পদার্থের অতিমাত্রায় তরলীকরণ করে লঘু ঘনত্বের বা হালকা দ্রবণ তৈরী করা শুরু করেন এবং দাবী করেন, যত বেশী হালকা ঘনত্বের তরল হবে বা দ্রবনে দ্রবীভুত সেই দ্রবটির (হোমিও মতে তাদের ঔষধ) পরিমান যত কম হবে, এর কার্য্যকরী প্রভাব তত বেশী শক্তিশালী হবে। আর এখান থেকে হ্যানিমান প্রস্তাব করেন, হোমিওপ্যাথীর আরেকটি মুলনীতি, যা পরিচিত Law of infintsimal হিসাবে।

এই সুত্রটি এ যাবৎ সুস্পষ্ট ভাবে প্রমানিত ফার্মাকোলজীর প্রতিষ্ঠিত ডোজ রেসপন্স (ঔষধের মাত্রা ও তার প্রভাব) সম্পর্কের একেবারেই বীপরিত; আর সঙ্গত কারনে এটি হোমিওপ্যাথীর সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়, যা এখনও হোমিওপ্যাথরা ব্যাখ্যা করতে পারেননি।

হোমিওপ্যাথীর Law of infintsimal সুত্রানুযায়ী, প্রস্তাবিত হোমিও ঔষধ হিসাবে চিহ্নিত কোন সক্রিয় উপাদান, দ্রবনের সাথে যুক্ত করার পর দ্রবনটিকে, ধারাবাহিকভাবে যতই লঘুকরণ করা হোক না কেন ( সাধারনত: ১:১০ বা ১:১০০ দ্রাব্য ও দ্রব অনুপাতে যা করা হয় ধারাবাহিক ভাবে), দ্রবীভুত উপাদানটি তার কর্মক্ষমতা হারাবে না ; এই অদ্ভুত দাবীর স্বপক্ষে হ্যানিমান অবশ্য কোন প্রমান দেবার প্রয়োজন মনে করেনি (তার নিজের ধারনাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট মনে করেছিলেন) ;

সুস্পষ্টভাবে যদিও হ্যানিম্যান প্রথম এই কাজটি শুরু করেছিলেন, প্রুভিং প্রক্রিয়ার সময় বিষাক্ততা হ্রাস করার জন্য, তবে পরে তিনি দাবী করেন এটা আসলে হচ্ছে একটি পোটেনাইজেশন বা Potenization প্রক্রিয়া, যা মুল উপাদানটির এসেন্স বা মুল সত্ত্বা বা স্পিরিট বা প্রান শক্তিটিকে বের করে আনে দ্রবনের মধ্যে। হোমিওপ্যাথ গবেষকরা যে বিষয়টা নিয়ে এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানের সব ধরনের মুলনীতিকে উপক্ষো করে প্রমান করার জন্য।

হ্যানিমানের জীবনের শেষের দিকে অবশ্য মলিক্যুলার ডাইলুশন বা আনবিক লঘুকরনের সীমা নির্দেশকারী আভোগ্যাড্রোর সংখ্যাটি আবিষ্কার হয়।কিন্তু ততদিনে পৃথিবীব্যাপী হোমিওপ্যাথরা দাবী করে এসেছেন আভোগ্যাড্রোর সংখ্যা অপেক্ষাও কম তরলীকরনে তাদের ঔষধ কর্মক্ষমতা হারায় না। হোমিওপ্যাথীর কার্য্যকারীতা সম্বন্ধে যে কোন যুক্তিবাদী মানুষদের মনে সংশয়ের জন্ম দিতে এই দাবীর অবাস্তবতা আসলে যথেষ্ট এবং তাদের উৎসাহিত করেছে এটি প্রত্যাখান করতে হয়তো কোন বিভ্রম নয়তো পুরো কল্পনা হিসাবে।

হোমিওপ্যাথীর চিকিৎসা বা রেমেডি গুলো সাধারনত তৈরী করা হয় খনিজ, ভেষজ বা অন্যান্য জৈব বা অজৈব উপাদান দিয়ে। যদি প্রস্তাবিত মুল উপাদানটি দ্রাব্য হয়, তার এক (১) অংশ হয় নয় (৯) অংশ বা নিরানব্বই (৯৯) অংশ ডিষ্টিলড বা পাতিত পানি বা /এবং অ্যালকোহলের সাথে মেশানো হয় এবং বেশ জোরে জোরে ঝাকানো হয় (যাকে বলা Succussion প্রক্রিয়া ); ( আর যদি দ্রাব্য না হয়, তবে সেটি সমপরিমান পাউডার বা গুড়া ল্যাক্টোজ (Lactose হচ্ছে দুধের শর্করা) এর সাথে মেশানো হয় ); এর পর এই দ্রবনটি ধারাবাহিকভাবে আরো লঘুকরণ করা হয়, যতক্ষন না পর্যন্ত এটি হোমিওপ্যাথদের তথাকথিত কাঙ্খিত ঘনত্বে না পৌছায়। ১ থেকে ১০ লঘুকরণকে সাংকেতিকভাবে রোমান হরফ X দিয়ে প্রকাশ করা হয় ( 1x = ১/১০, 3x = ১/১০০০, 6x = ১X ১০০০০০০), ১ থেকে ১০০ তরলীকরণকে সাংকেতিকভাবে প্রকাশ করা হয় C দিয়ে ( 1C = ১/১০০, 3x = ১/১০০০০০); বেশীর ভাগ রেমেডিই ৬X থেকে ৩০X, তবে ৩০C বা তারও বেশী লঘুকৃত ঔষধ বাজারে পাওয়া যায় । এখন এই ৩০X এর অর্থ যে মুল উপাদানটিকে লঘুকরণ করা হয়েছে ১০^৩০ মাত্রায়। যদি ধরা যায় এক ঘন সেন্টি মিটারে ১৫ ফোটা পানি থাকে তবে এমনি একটি সংখ্যার পানির ফোটার জায়গা লাগবে পৃথিবীর চেয়ে আকারে ৫০ গুন বড় একটি পাত্র। এবার চিন্তা করুন এক ফোটা লাল রং এমন কোন বড় পাত্রের ফেলা হলো এই আশায় যে এটি সমানভাবে মিশ্রিত হবে। হোমিওপ্যাথীর ল অফ ইনফিনিটিসেমাল যা দাবী করছে তা হলো অনেকটা এরকম: কেউ যদি এখন এই পাত্র থেকে যে কোন এক ফোটা পানি নিক না কেন, সেই ফোটায় ঐ লাল রঙ এর মুল সত্ত্বা বা এসেন্সটি ধারন করবে। আমেরিকার ফিজিক্যাল সোসাইটির প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড এল পার্ক উল্লেখ করেছিলেন, যেহেতু কোন দ্রবনে সবচেয়ে কম পরিমানটি হচ্ছে মুল সক্রিয় উপাদানের কমপক্ষে অন্তত একটি, অর্থাৎ হোমিওপ্যাথদের দাবী করা একটি ৩০C দ্রবনে কমপক্ষে ১০০^৩০ ( বা ১ এর পর ৬০টি শুন্য) পানির অনুতে এক অনু মুল উপাদানটি দ্রবীভুত থাকতে হবে, যার জন্য পৃথিবীর চেয়ে ৩০ বিলিয়ন বড় আকারের পাত্র প্রয়োজন।

Occillococcinum, একটি ২০০C প্রোডাক্ট, যা ফ্লুর চিকিৎসার জন্য হোমিওপ্যাথরা ব্যবহার করেন, তার যে লঘুকরন দাবী করা হচ্ছে সেটা আরো বিস্ময়কর। এই ঔষধটির তথাকথিত সক্রিয় উপাদানটি তৈরী করা হয় সদ্য জবাই করা হাসের লিভার বা কলিজা এবং হৃদপিন্ড ৪০ দিন ইনকিউবেট করে। এর পর যে তরলটি পাওয়া যায়, তাকে ফিল্টার করে, ফ্রিজ ড্রাই করা হয়, এরপর আবার পানিতে মেশানো হয় এবং বার বার তরলীকৃত করে চিনির সাথে মেশানো হয়। যদি হাসের কলিজা এবং হৃদপিন্ডের একটি অনুকে এই তরলীকরন প্রক্রিয়ায় টিকে থাকতে হয়, তবে এর ঘনত্ব হবে প্রতি ১০০^২০০ ( ১ এর পর ৪০০ শুন্য) অনুতে ১ টি। এই সংখ্যাটি, ১ এর পর প্রায় ৪০০ শুন্য সমস্ত মহাবিশ্বে যে পরিমান অনু ( প্রায় ১ গুগল বা googol, যা ১ এর ১০০টি শুন্য) আছে বলে ধারনা করা হয় তারচেয়েও অনেক বেশী। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট অনুযায়ী বছরে এই ঔষধ তৈরী করতে মাত্র ১ টি হাস জবাই করলেই যথেষ্ট, অথচ ১৯৯৬ সালে এই ঔষধটির মোট বিক্রির পরিমান ছিল প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার; পত্রিকাটি সেই হতভাগা হাসটি নাম দিয়েছিল, ২০ মিলিয়ন ডলার ডাক বা হাস।

রসায়নের সুত্রই বলছে লঘুকরনের একটা সীমা আছে, এর পর সেই দ্রবনে দ্রবর উপস্থিতি আর থাকবে না। এই সীমা যা আভোগাড্রোর সংখ্যা বলে পরিচিত, যা হোমিও তরলীকরনের ১২C বা ২৪X এর সমতুল্য। রসায়নে দক্ষ হ্যানিমান কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন, তার অতিমাত্রার এই সব লঘুকরনে সক্রিয় উপাদানের কোন অস্তিত্ব থাকা সম্ভব না। তবে তিনি মনে করতেন, খুব ভালো করে ঝাকানোর ( Succussion, তরল না হলে খুব দৃঢ় ভাবে একে গুড়া করতে হবে, যাবে বলে Trituration)) সময় সক্রিয় উপাদানটির স্পিরিট বা এসেন্স বা মুল স্বত্তাটি দ্রবনের সাথে মিশে যাবে, অর্থাৎ শেষ দ্রবনে যদি কোন অনুও না থাকে সেক্ষেত্রে এর কাজ করতে কোন অসুবিধা হবেনা। অর্থাৎ দ্রাবক তরল ঠিকই মনে রাখবে সেই উপাদানটিকে। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে দ্রাবক তরল বা যেমন পানি, তার সংস্পর্শে আসা সব উপাদানকেই মনে রাখার কথা এবং নিশ্চয়ই সেটা অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলবে সক্রিয় হোমিও উপাদানটির কাজে। পার্ক এর মতে কেউ যদি হোমিওপ্যাথদের ৩০X কোন পিল বা বড়িতে এক অনু তথাকথিত সক্রিয় উপাদান গ্রহন করতে চান তাকে প্রায় ২ বিলিয়ন পিল খেতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন প্রায় হাজার টন নানা অবিশুদ্ধ উপাদান সহ ল্যাকটোজ । হোমিও সমর্থকদের অনেকে এই চিকিৎসাগুলোর সাথে ভ্যাক্সিন বা টীকার সাথে তুলনা করেন কিন্তু তুলনাটি ঠিক না, কারন ভ্যাক্সিনে সক্রিয় উপাদানের পরিমান অনেক বেশী এবং সেখানে কি পরিমান সক্রিয় উপাদান আছে সেটি পরিমাপযোগ্য। এছাড়া প্রতিষেধকরা রক্তে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে, যার ঘনত্ব পরিমাপ করা যায়। কিন্তু অতি লঘু মাত্রার কোন হোমিও ঔষধ কোন ধরনের পরিমাপযোগ্য রেসপন্স তৈরী করেনা।

কার্টুন সুত্র:  xkcd

হলিজম এবং উপসর্গগুলোর মোট বৈশিষ্টর উপর নির্ধারিত চিকিৎসা:

হোমিওপ্যাথীর আরেকটি মুলনীতি হলো হোমিও রেমেডি সবচেয়ে বেশী কাজ করে যখন কোন রোগীর উপসর্গগুলোর সার্বিক বা মোট বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী (রোগের বৈশিষ্টসুচক উপসর্গানুযায়ী না) তাদের চিকিৎসা করা হয়, যেমন কোন রোগী যারা প্রধান উপসর্গ হচ্ছে, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখ লাল হয়ে জ্বালা পড়া করা, নাক দিয়ে পরিষ্কার পানির মত নি:সরণ, এ ক্ষেত্রে রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয় পেয়াজ (Allium cepa) এর নির্যাস থেকে তৈরী একটি চিকিৎসা দিয়ে। আবার যদি কোন রোগী, এমন উপসর্গ নিয়ে আসে যেমন: ঘন হলদে রঙের নাকের নি:সরন, যার ক্ষুধা তৃষ্ণা কমে গেছে এবং ঠান্ডা পরিষ্কার বাতাস যার কাম্য, সেই রোগীর চিকিৎসা করতে হবে পার্পল কোন (Purple cone) ফুলের নির্যাস দিয়ে ( Pulsatilla); দুজন রোগীর রোগ কিন্তু একই, শুধু ভিন্ন উপসর্গের কারনে তাদের চিকিৎসা করা হয় ভিন্ন ভিন্ন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিয়ে। বিষয়টি হোমিওপ্যাথী সংক্রান্ত কোন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সমস্যা তৈরী করে। কারন প্রচলিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মত সুনির্দিষ্ট সিলেকশন ক্রাইটেরিয়ার মত কিছু সাধারন হোমিও ট্রায়ালগুলোয় থাকেনা, সেখানেও হোমিও নিয়মানুসারে ট্রায়ালে অংশগ্রহনকারী রোগীদের বাছাই করা হয়। এছাড়া গত দুই শতাব্দী ধরে অসংখ্য ম্যাচিং ( উপসর্গ ও অসুখ ও হোমিও রেমেডি) প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করেছেন হোমিওপ্যাথরা ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায়, যেখানে নির্দিষ্ট কোন স্ট্যান্ডার্ড প্রক্রিয়ার উপস্থিতি কখনো ছিল না।

অতি মাত্রায় লঘুকৃত যুক্তি

হোমিওপ্যাথী ঔষধকে কার্যকর দাবী করতে হলে, তাদের কাজ করার একটি ব্যাখা যোগ্য প্রক্রিয়া থাকতে হবে। এখনো পর্যন্ত হোমিওপ্যাথী ঔষধগুলো কিভাবে কাজ করে সেই বিষয়টি জানা যায়নি। যদি আমরা হোমিওপ্যাথদের দাবী অনুযায়ী মেনে নেই যে, তাদের এই ঔষধগুলো কাজ করছে, তাহলে তারা অবশ্যই পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, এবং ফার্মাকোলজীর সকল প্রতিষ্ঠিত সুত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কাজ করছে বা ‍তাদের কাজ করার উপায় এমন কোন কিছু যা এখনও কারো পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। হোমিওপ্যাথীর একজন সমালোচকের ভাষায়, যদি হ্যানিম্যান ঠিক হন, তাহলে আমাদের বিজ্ঞান এবং বিশ্লেষন পদ্ধতি সব ভুল, আর যদি তিনি ভুল হন, তাহলে তার মতবাদ অর্থহীন।

কোন সক্রিয় উপাদানকে ধারাবাহিকভাবে ডাইলুশন বা লঘুকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলে খুব দ্রুত অত্যন্ত তরলীকৃত দ্রবন প্রস্তুত করা কিন্তু সম্ভব। তবে তরলীকরন তার শেষ সীমায় পৌছে যায় যখন দ্রবনে সেই দ্রাব্যটির আর কোন অনুরই থাকার সম্ভাবনা থাকেনা। এই সীমাটা যা একটি বিশাল সংখ্যা তবে অসীম নয়, সুনির্দিষ্ট সংখ্যক অনু থাকে এক মোল (Mole) কোন পদার্থে ( Mole হচ্ছে কোন পদার্থের আনবিক ওজন, যা গ্রামে প্রকাশ করা হয়); এই এক মোল কোন পদার্থের মোট অনুর সংখ্যা ৬.০২২ X ১০২৩ , যা আভোগ্যাড্রোর সংখ্যা (Avogadro’s number) হিসাবে পরিচিত।

আগে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে যে, হোমিওপ্যাথীর চিকিৎসা হিসাবে ব্যবহার করা হয় এমন ঔষধগুলো সাধারন লঘু করন করা হয় ১০ বা ১০০ গুনিতক হারে। ‘ X বা D মানের কোন লঘু দ্রবণ তৈরী করা হয়, ১:১০ এর ধারাবাহিক তরলীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং C লঘু মানের ঔষধগুলো তৈরী করা হয়, ১:১০০ এর ধারাবাহিক তরলীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এভাবে কোন ঔষধের ‍গায়ে যদি লেখা থাকে C30 তাহলে বোঝায় এটি ১:১০০ হারে এটি তরলীকরণ করা হয়েছে ৩০ বার। সুতরাং সহজ গনিতই বলছে, C12 বা D24 তরলীকরন পর্যায়ে বা এর উপরে কোন তরলীকরনে এই ঔষধে সেই সক্রিয় উপাদানটি থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই। আর মুল উপাদানটি হোমিও ঔষধে যখন অনুপস্থিত তবে এটি কিভাবে কাজ করে তা কল্পনার উপর ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

অবশ্য নানা ধরনের প্রস্তাব করেছেন হোমিওপ্যাথ মতবাদীরা, সক্রিয় উপাদান না থাকলে কি হবে, তার চিহ্ন থেকে যায় দ্রবনে, যেমন, স্থায়ী বরফের ক্রিষ্টাল বা স্ফটিক তৈরী করে, বা পানি চুম্বকীয় প্রকৃতি পরিবর্তন করে কিংবা বা পানিতে প্রোটিন খোলস তৈরী করা মাধ্যমে। পানির অনু অত্যন্ত পোলারাইজ, একারনে জীববিজ্ঞানে এর বিশেষ একটা ভুমিকা আছে। তবে হোমিওপ্যাথী ঔষধ তৈরী করার সময় যে জোরে ঝাকুনী দেয়া হয়, সেখানে কিভাবে কল্পিত জটিল বরফ এর স্ফটিক এর ন্যায় কোন কিছু যে অক্ষত থাকে সেটা সহজে অনুমেয়, এছাড়া এই কল্পিত স্টাকচারটি যে কাজ করে বলে দাবী করা হয় তার কোন প্রমানও পাওয়া যায়নি। এছাড়াও কিছু প্রস্তাবনা আরো অসমর্থনযোগ্য, যেমন দাবী করা যে হোমিও ঔষধের চিকিৎসা পদ্ধতি বায়োলজীক্যাল মাগনেটাইট এর সাথে কোন না ভাবে জড়িত। এর সমালোচনা ম্যাগনেটাইটের আবিষ্কারকই করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন এ ধরনের প্রস্তাব ম্যাগনেটাইটের গঠন সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতাকেই প্রকাশ করে। এছাড়া পানিও কিন্তু ফেরোম্যাগনেটিক নয়।

এছাড়া যে পস্তাবটি করা হয়, কোন সক্রিয় উপাদান না থাকলেও পানি বা দ্রবনের মধ্যে এর সক্রিয় উপাদানটি একটি স্থায়ী চিহ্ন রেখে যায়, বা ‘পানি মনে রাখে’ গঠনটি, যা Memory of Water বা পানির স্মৃতি বলে দাবী করা হয়। কিন্তু এ কোন ধরনের প্রস্তাবিত কোন গঠনগত পরিবর্তন কিন্তু পরীক্ষার মাধ্যমে দেখার মত প্রযুক্তি বহুদিন ধরেই বিদ্যমান ( যেমন ট্রান্সমিশন ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি, স্পেকট্রোস্কোপি, আল্ট্রাভায়োলেট ট্রান্সমিশন ক্যারেক্টারিস্টিকস,এক্সরে এবং আল্ট্রাসাউন্ড ইত্যাদি); যদি আসলেই এর অস্তিত্ব থাকে, তবে হোমিওপ্যাথিক ঔষধে এই সব গঠনগত পরিবর্তন শনাক্ত করা সম্ভব হত এদের মধ্যে যে কোন একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করেই। কয়েকটি আল্ট্রাসনোগ্রাফিক টেষ্ট প্রমান করেছে পানি এবং হোমিও চিকিৎসার ঔষধের কোন পার্থক্যই নেই। এমনকি পরীক্ষা মুলকভাবে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক এবং রোগীরা আলাদা করে দুটি সম্পুর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির বা প্রভাব ফেলে এমন হোমিও রেমেডিও আলাদা করতে ব্যার্থ হয়েছে প্রায় ৯ বছর ধরে পরিচালিত একটি গবেষনায়।

পদার্থবিদ্যার দৃষ্টিতে খুবই লঘুকৃত পানিতে কোন গঠনগত পরিবর্তন খুব অসম্ভাব্য একটা ব্যাপার। পানি বা অ্যালকোহলের মিশ্রনের পরীক্ষায় যা দেখা যায় সেই পরিবর্তনগুলো স্থানীয় এবং ক্ষনস্থায়ী,যা নির্ভর করে তাপমাত্রার উপর এবং খুব সামান্য সময়, এছাড়া অনেক পদার্থর জন্যই স্থানীয় গঠনের সন্নিবেশ বা অর্ডার তরলাবস্থায় থাকতে পারেনা ( কারন এনট্রপি) কিছু ব্যতিক্রম হচ্ছে লিকিউড ক্রিষ্টাল, যার বেশ দীর্ঘাকৃতির অনুগুলো একবার তৈরী হলেও তারা কিন্তু বেশী নাড়াচড়া করতে পারেনা যখন সেই তরলাবস্থা সৃষ্টি হয়; এখনও পর্যন্ত কোন পরীক্ষা বা তাত্ত্বিকভাবে দেখা সম্ভব হয়নি বা সামান্য আভাসও পাওয়া যায়নি যে, পানি আসলে লিকুইড ক্রিষ্টাল তৈরী করতে পারে।

হোমিওপ্যাথরা অবশ্য এটাও বলেছেন যে, কোন ভৌতিক বা ফিজিক্যাল সুত্র না মেনেই এরা কাজ করে, অবশই এধরনের কল্পনার তো আর পরীক্ষামুলক কোন প্রমান দেয়া সম্ভব না,তবে বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত এমন কোন পদার্থ পায়নি যা এ ধরনের আচরন করে। সুতরাং কোন অপ্রমানিত প্রাকৃতিক ফেনোমেনাকে ব্যাখ্যার জন্য অজানা সুত্রের এ ধরনের দোহাই দেয়া নি:সন্দেহে আইনসিদ্ধ বিজ্ঞানের কোন আওতায় পড়ে না।

হোমিওপ্যাথীর তরলীকরন প্রক্রিয়ায় আরো একটি বিস্ময়কর সমস্যা হলো, এ ধরনের বেশ কিছু রেমেডি ল্যাকটোজ ট্যাবলেট হিসাবে পাওয়া যায়। এসব ক্ষে্ত্রে হোমিও ডাইলুশন পিলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, যারা ক্যারিয়ার হিসাবে কাজ করে। অবশ্যই তরলীকৃত তরলকে বাষ্পীভুত হতে হবে, এখানে তাহলে প্রশ্ন তরল থেকে কিভাবে তথ্যটি পিলে স্থানান্তরিত হয়।

আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন হলো তরলীকৃত মিশ্রন কেন শুধু সক্রিয় উপাদানের নিরাময় ক্ষমতাকে মনে রাখে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াদের ভুলে যায় বা কেনই বা পানি এর সাথে সংস্পর্শে আসা অন্য উপাদানসমুহকেও বিশেষভাবে ভুলে যায়। আসল সত্যটি হচ্ছে এই অতিমাত্রায় তরলীকৃত হোমিও রেমেডি কিভাবে কাজ করে তার কোন বোধগম্য প্রক্রিয়া আজো বর্ণনা করা সম্ভব হয়নি, ফলে কোন পরীক্ষিত উপায়ে হোমিওপ্যাথি রেমেডির কার্যকারীতা প্রমান করা সম্ভব না, সেকারনে ঔষধ কিভাবে কাজ করে তার ব্যাখ্যায় না গিয়ে বেশীর ভাগ হোমিও গবেষনা বিশেষ তাদের ফলাফল আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন।

১৯৮৮ সালে হোমিওপ্যাথী আরো একবার বিতর্কের মুখোমুখি হয়, হোমিও লঘুকরনের কার্যকারীতার সমর্থনে নেচারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে। এখানে লেখকদ্বয় দাবী করেন আমাদের শরীরের একধরনের অ্যান্টিবডি ( যা অ্যালার্জীর ‍সাথে জড়িত) IgE খুবই তরলীকৃত দ্রবন বেসোফিলে ডিগ্রানুলেশনের প্রক্রিয়ায় কাজ করে। জার্নাল নেচার প্রাথমিকভাবে এর ঘাটতিগুলো খুজে পেতে ব্যার্থ হয়, তবে প্রকাশনার পর পত্রিকাটি একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করে যাচাই করার জন্য। এবং তারা পুরো পরীক্ষায় বেশ কিছু ভুল দেখতে পান, এর পরের বিতর্ক চলে বেশ কিছু দিন, স্বতন্ত্রভাবে অন্য বিজ্ঞানীরাও এই ফলাফল পেতে ব্যার্থ হন। দেখা যাচ্ছে একটি মাত্র ল্যাব থেকেই এই বিতর্কিত ফলাফলটি এসেছে ,এতো সমালোচনার পরও মুল গবেষক দমে যাননি। তিনি ডিজিবায়ো নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরী করেন, যা দাবী করে আসছে পানির শুধু মেমোরী যে আছে তাই না, এই মেমোরীকে ডিজিটাইজ করা সম্ভব এবং তা ইন্টারনেট, টেলিফোন বা ডিস্কের মাধ্যমে প্রেরণ করা যেতে পারে। পরে ফরাসী গবেষনা কর্তৃপক্ষ তার ল্যাবটি বন্ধ করে দেয় এছাড়া তারা একে অপবিজ্ঞান হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের প্রতি গবেষকদ্বয়ের দায়ের করা মানহানির মামলাও কোর্ট খারিজ করে দেয়।

হোমিওপ্যাথী কি প্ল্যাসিবো থেকে কার্য্যকর???

হোমিওপ্যাথী আসলেই কাজ করে কিনা তা পরীক্ষার জন্য তিনটি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয়া হয়। প্রথমত, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বা রেমেডির কার্য্কারিতার সাথে প্লাসিবো ( যাদের ঔষধের বিকল্প হিসাবে দেয়া হয়, কোন ঔষধ নয়) তুলনামুলক গবেষনা, দ্বিতীয়ত, কোন একটি নির্দিষ্ট অসুখ বা ক্লিনিক্যাল কন্ডিশনের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের কার্য্যকারীতা, তৃতীয়ত, নানা মাত্রায় বা পোটেন্সিতে এর কার্য্যকারীতা সংক্রান্ত ল্যাবরেটরী নির্ভর গবেষনা বিশেষ করে অতিমাত্রায় কম ঘনত্বের দ্রবণ বা আল্ট্রা হাই ডাইলুশন এর ক্ষেত্রে। প্রথমটির ক্ষেত্রে আমরা তথ্য পাই নানা হোমিওপ্যাথিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, বিশেষ করে প্ল্যাসিবো -কনট্রোলড র্যােনডোমাইজইড ট্রায়ালগুলোর সিস্টেম্যাটিক রিভিউ এবং মেটা অ্যানালাইসিস এর মাধ্যমে। এ ধরনের অ্যানালাইসিসে দেখা হয় হোমিওপ্যাথী চিকিৎসা যারা পাচ্ছে এবং যারা চিকিৎসা হিসাবে প্ল্যাসিবো পেয়েছে, তাদের মধ্যে আসলেই তুলনামুলক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে কিনা; এখানে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে নানা অসুখের চিকিৎসায় গৃহীত ট্রায়ালগুলো নির্বাচন করা হয় পর্যালোচনা করার জন্য। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিশেষ কোন অসুখের ক্ষেত্রে সাধারনত একই ধরনের রোগীদের নিয়ে করা ট্রায়ালগুলো অ্যানালাইসিস করা হয়। আর তৃতীয় ক্ষেত্রে নানা মাত্রার পোটেন্সির হোমিওপ্যাথী ঔষধগুলোর কার্য্যকারীতা নিয়ে গবেষনার ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরী টেষ্ট এর মাধ্যমে বিশেষ পরিবেশে গবেষনাগুলো চালানো হয়।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে হোমিওপ্যাথীর কার্য্যকারীতা নিয়ে বিতর্ক, হোমিওপ্যাথীর জন্মলগ্ন থেকেই এর সাথে সংশ্লিষ্ট নানা বিতর্কের ব্যতিক্রম না। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ১৫০ টির বেশী কন্ট্রোলড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে হোমিওপ্যাথী চিকিৎসা নিয়ে, যা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলাফল সব যেমন ইতিবাচক না আবার সব নেতিবাচকও না। একারনে এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই কোন রিভিউয়ার বা পর্যালোচনারত গবেষকের নিজস্ব প্রাকধারনা মোতাবেক পছন্দনীয় গবেষনাগুলো বাছাই করার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই পুর্বনির্ধারনের সমস্যাটা সবচেয়ে ভালোভাবে কাটানো যায় যদি বিশ্বাসযোগ্য প্রমানগুলোকেই শুধু যথাযথ মুল্যায়ন করা যায়। এখানেই সিস্টেম্যাটিক রিভিউর আগমন। তারপরও দেখা যায় এই সিস্টেম্যাটিক রিভিউর পর্যায়েও হোমিওপ্যাথী সম্বন্ধে ফলাফল সব সময়ই এক হয়না। যেমন, ১৯৯৭ সালের একটি ল্যান্সেট (Lancet) এর একটি রিভিউ দাবী করেছিল, হোমিওপ্যাথীর ক্লিনিক্যাল সাফল্য পুরোপুরি এর প্ল্যাসিবো প্রভাবের জন্য নয়। ২০০৫ এ অপর একটি রিভিউ দাবী করে হোমিওপ্যাথীর কার্য্যকারীতা প্ল্যাসিবো প্রভাবের জন্যই ঘটে। ২০০২ সালে এডজার্ড আর্ণস্ট এর একটি রিভিউ, যা প্রায় ১৭ টি প্রধান সিস্টেমিক রিভিউর একটি রিভিউ, দাবী করে, হোমিওপ্যাথীর কার্য্যকারীতার সংক্রান্ত এ যাবত পাওয়া সব প্রমান বলছে, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে হোমিওপ্যাথীর ব্যাবহার কোন ইতিবাচক রিকমেন্ডশন দাবী করার যোগ্যতা রাখেনা, কারন এর কার্য্যকারীতা প্ল্যাসিবো থেকে ভিন্ন নয়।

হোমিওপ্যাথরা সমসময় তাদের বিপক্ষে উপসংহার টানা সিস্টেমেটিক রিভিউগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন পক্ষপাতিত্বের: সে কারনে ২০১০ এ সবচেয়ে সেরা রিভিউ হিসাবে স্বীকৃত, যা সাম্প্রতিক তথ্য সম্বলিত, পক্ষপাতদুষ্ট নয় এমন নিয়মমাফিক স্বচ্ছ প্রক্রিয়া বাছাইকরা পেপারগুলো নিয়ে করা রিভিউগুলো যেগুলো সাধারনত কখরান (Cochran) রিভিউতে ঠাই পায়। সেই কখরান ডাটাবেস থেকেই এডজার্ড আর্ণষ্ট কতগুলো সিস্টেমেটিক রিভিউর একটি রিভিউ এবং মেটা অ্যানালাইসিস করেন। এই রিভিউর বৈশিষ্ট ছিল পেপারগুলোর বেশীরভাগই ছিল খোদ হোমিওপ্যাথী চিকিৎসকদের, সুতরাং তাদের হোমিওপ্যাথীর বিরোধী ভাবার তেমন কোন অবকাশ নেই, বরং উল্টোটাই বলা যেতে পারে। এই রিভিউর উপসংহারেও দেখা যায় হোমিওপ্যাথীর প্ল্যাসিবোর অতিরিক্ত কোন প্রভাব নেই। কখরান ডাটাবেসের বাইরে আরো অনেক রিভিউও আছে যেখানেও গবেষকরা নেতিবাচক ফলাফলই পেয়েছেন। এবং সাম্প্রতিক কালের রিভিউগুলোতে হোমিওপ্যাথীর প্ল্যাসিবো অতিরিক্ত কোন কার্য্যকারীতার বিপক্ষে প্রমান ক্রমশ বাড়ছে। বহু গবেষকই স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন হোমিওপ্যাথীর মুল ধারনাটাই বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।

হোমিওপ্যাথীর মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে করা গবেষনাগুলো যারা রিভিউ করেছেন তারাও দেখেছেন এ ধরনের তথ্য উপাত্তের মান কত নিম্নমানের এবং এছাড়া কোন গবেষনার ফলাফল পুণরাবৃত্তি করা সম্ভব হয়েছে এমন উদহারনের অভাবও রয়েছে । কোন ইতিবাচক ফলাফলই স্থিতিশীল না, যা কিনা পরবর্তী কোন গবেষকের গবেষনায় প্রমানিত হয়েছে। এসব ফলাফলই বলছে প্ল্যাসিবোর অতিরিক্ত কোন প্রভাব ফেলার কোন প্রমানই হোমিওপ্যাথীর স্বপক্ষে নেই। অবশ্য হোমিওপ্যাথরা এটি অস্বীকার করে এসেছে বার বার এবং এর পক্ষে তারা আরো দুর্বল প্রমান যুগিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। তাদের এই ইতিবাচক রিভিউগুলো অ্যানালাইসিস করলেই দেখা যায় কি ধরনের বায়াস বা পক্ষপাতিত্ব আছে সেখানে: যেমন কোন রিভিউয়ার সচেতনভাবে বেছে সেই সব গবেষনাগুলো যোগ করেছেন যাদের ফলাফল ইতিবাচক, এবং বাদ দিয়েছেন সব নেতিবাচক স্টাডিগুলো।

হোমিওপ্যাথরা দাবী করেন যে বেশ কিছু পর্যবেক্ষনমুলক গবেষনা আছে যা এর কার্য্যকারীতার প্রমান বহন করে, এবং তাদের ভিত্তিহীন একটি প্রস্তাব হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত কোন কনট্রোলড স্টাডি হোমিওপ্যাথীর গবেষনার জন্য উপযুক্ত না, শুধু মাত্র পর্যবেক্ষনমুলক গবেষনাগুলোই পারে হোমিওপ্যাথীর কার্য্যকারীতার প্রমান করতে। সম্ভবত এ ধরনের প্রস্তাবে যৌক্তিক কারন হচ্ছে হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নয় এমন কিছু প্রভাবের ফলে সৃষ্ট ইতিবাচক ফলাফলগুলো ( যেমন সহানুভুতিশীল, সুদীর্ঘ পরামর্শ করার সময়, যা হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার বিশেষ বৈশিষ্ট) দেখা যায় পর্যবেক্ষন নির্ভর গবেষনায়; তবে অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যায় হোমিওপ্যাথী প্ল্যাসিবো ছাড়া আর কিছু না। কখরান রিভিউগুলোর মধ্যে একটি যেমন কাসাব ও তার সহযোগীরা (২০০৯) তাদের প্রাথমিক বিশ্লেষনে হোমিওপ্যাথীর কার্যকারীতা আছে বলে দেখতে পান, এই প্রমানের কারণ আসলে যে ঔষধটাকে দ্রবীভুত করা হয়েছে সেটির উপর নির্ভরশীল; কারণ যদি দ্রবন তৈরীই করা হয় এবং সেটি হোমিও মতে করা হয় তাহলে টেকনিক্যালী এটি হোমিও ঔষধ, এমনকি যখন তা অতিরিক্ত লঘু করা হয়নি । এর অর্থ হচ্ছে যদিও অতি লঘুকরনের কারনে, প্রচলিত হোমিও ঔষধে কোন কার্য্যকরী বা ফার্মাকোলজীক্যালী সক্রিয় কোন উপাদান থাকার কথা না, তবে কিছু হোমিওপ্যাথী ঔষধে সক্রিয় উপাদান বিদ্যমান থাকতেও পারে, যেমন কেউ চাইলে অ্যাসপিরিন এর একটি হোমিওপ্যাথীক দ্রবন তৈরী করতে পারে, হোমিও নিয়ম মেনেই এবং লঘুকরনের মাত্রাটিকে পরিবর্তন করে। সুতরাং বিস্ময়ের খুব বেশী কারন নেই যে এধরনের ঔষধের অবশ্যই কিছু প্রভাব থাকতেই পারে। কিন্তু এই ধরনের হোমিও চিকিৎসার উপাত্তের ‍ভিত্তি করে বলাটা ঠিক না যে প্রস্তাবিত হোমিও ঔষধটি আসলেই ‘কাজ‘ করছে।

অবশ্যই নানা ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি সংক্রান্ত গবেষনায় পরস্পর বিরোধী ফলাফল পাওয়াটা কিন্তু নতুন কোন ব্যাপার না। আগেই যেমন উল্লেখ করেছি, এই সমস্যার সমাধানের একটি উপায় হলো সঠিকভাবে নিয়ম মেনে করা গবেষনাগুলোর সিস্টেম্যাটিক রিভিউ এবং মেটা অ্যানালাইসিস করা। সেই ১৯৯৭ সালের, লিন্ড ও তার সহযোগীরা প্রথমত সেই কাজটি করেছিলেন, তার মেটা অ্যানালাইসিস ধারনা দেয় যে, হোমিওপ্যাথী প্ল্যাসিবো থেকে কিছুটা বেশী, তবে লেখকরা এটাও বলেছিল এমন কোন স্বাস্থ্য সমস্যা তারা চিহ্নিত করতে পারেননি যেখানে এটি প্ল্যাসিবোর তুলনায় বেশী কার্যকর। এটি এবং আরো কয়েকটি পদ্ধতিগত সমস্যা থাকা স্বত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী হোমিওপ্যাথটা বেশ উচ্ছসিত হয়েছিলেন তাদের চিকিৎসা পদ্ধতির প্রমান মিলেছে এমন একটি আত্মপ্রসাদে। বেশ দ্রুতই হোমিওপ্যাথী সমন্ধে আগ্রহও বেড়েছিল, আরো কিছু সিস্টেম্যাটিক রিভিউও এর পর প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের পর থেকে প্রকাশিত সেই সব রিভিউগুলো নিয়ে পরবর্তীতে এডাজার্ড আর্নষ্ট একটি সিস্টেমেটিক রিভিউগুলোর সিস্টেমেটিক রিভিউ করেন, উদ্দেশ্য হোমিওপ্যাথির ঔষধগুলোর ক্লিনিক্যাল কার্য্যকারীতা বিচার।এই নতুন অ্যানালাইসিসে দেখা যায় লিন্ড এবং তার সহযোগীদের মুল মেটা অ্যানালাইসিসে যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো অপেক্ষাকৃত বেশী নিয়মমাফিক ছিল, সেখানে ইতিবাচক ফলাফলের পরিমাপ খুব সামান্য যা, সামগ্রিক কোন ইতিবাচক ফলাফলকে সমর্থন করতে ব্যর্থ হয় সবধরনের সাধারন প্রচলিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মানদন্ডে। একটি বিশ্লেষন প্রমান করে যে, মেটাঅ্যানালাইসিসের প্রাথমিক ইতিবাচক ফলাফলের কারন আসলে, পাবলিকেশন বায়াস অর্থাৎ যে স্টাডিগুলোর ফলাফল ইতিবাচক ও সফল, দেখা যাচ্ছে সেগুলো প্রকাশও হয়েছে বেশী, এবং তাদের অন্তর্ভুক্তি মোট মেটাঅ্যানালাইসিসে ভারসাম্যটিও বদলে দিয়েছে। এ বিষয়টি আগের গবেষকরা লক্ষ্য করেছিলেন তবে বিষয়টি তারা উপেক্ষা করেন। সুতরাং লিন্ড এবং তার সহযোগী মুল ডাটার বিশ্লেষন আসলে প্রমান করে যে তাদের পাওয়া ফলাফল সঠিক ছিল না।

এছাড়া আরো ১১ টি স্বতন্ত্র সিস্টেমেটিক রিভিউ হয়েছিল, যাদের উপাত্ত বিশ্লেষন বলছে সামগ্রিকভাবে হোমিও ঔষধ নির্দিষ্ট কোন অসুখের ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়। এখানে অবশ্য দুটি ব্যতিক্রম পেয়েছিলেন গবেষকরা, প্যারালাইটিক ইলিয়াস এবং ইনফ্লুয়েন্জা। এছাড়া সবচেয়ে বেশী পরীক্ষা করা হয়েছে এমন একটি হোমিও ড্রাগ আর্নিকা, যা প্ল্যাসিবো থেকে বেশী কার্যকরী নয়। ইনফ্লুয়েন্জা প্রতিরোধ আর চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ঔষধ ওসিলোকক্সিনাম (ocillococcinum) কে কার্যকর হিসাবে লক্ষ্য করা হয়েছে যে স্টাডিতে, সেখানে এই ইতিবাচক ফলাফলের ইফেক্ট সাইজ বা পরিমাপ এত সামান্য যে, বিষয়টির ঔষধ হিসাবে কার্য্যকারীতার বিতর্ক শেষ হয়নি। এছাড়া ocillococcinum স্বপক্ষে প্রমানও খুব সামান্য, সেকারনেই চুড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়াও সম্ভব না। অন্যদিকে পোস্টঅপারেটিভ ইলিয়াস ( যা সাধারন কিছু ধরনের অস্ত্রোপচারের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যখন আমাদের অন্ত্রনালী তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারেনা) সংক্রান্ত ট্রায়ালগুলোর রিভিউ ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে বিশ্লেষনের সময়, কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু সমস্যার কথা মাথায় রাখতে হবে তাহলে সে বিশেষ মাল্টি সেন্টার স্টাডিটি এর কার্য্যকারীতা বোঝার চেষ্টা করেছে সেটি স্টাডিটি কিন্তু কোন ইতিবাচক ফলাফল দেখাতে পারেনি। একটি স্বতন্ত্র রিভিউ যা বেশ কিছু র্যা নডোমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালকে বিশ্লেষন করেছে, তারা খানিকটা ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে, কিন্তু তাদের এই ফলাফলে পৌছানোর পরিসংখ্যান প্রক্রিয়াটি এখনও বিতর্কিত এবং গবেষকরা খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন তার ফলাফল খুব সামান্য ইতিবাচক যা দিয়ে ঢালাওভাবে হোমিও চিকিৎসাকে ব্যবহারের প্রস্তাব করা যায় না। সামগ্রিকভাবে এই উপাত্তগুলো হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা প্ল্যাসিবো থেকে ভিন্ন এমন কোন প্রমান দেয়না। যদি প্রিক্লিনিক্যাল ডাটাও পর্যালোচনা করা হয়, সেখানেও প্রকাশিত প্রায় ১২০ টি গবেষনাপত্রের সিস্টেমেটিক রিভিউতে গবেষকরা দেখেছেন, কোন ইতিবাচক ফলাফল বিশিষ্ট পরীক্ষা স্বতন্ত্রভাবে পুনপরীক্ষা করে একই ফলাফল প্রমান করা কিন্তু যায়নি; এছাড়া পদ্ধতিগত ভুল এবং পরস্পর বিরোধী ফলাফল কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নেবার পক্ষে প্রধান অন্তরায়। অ্যাভোগাড্রোর সংখ্যারও বেশী দ্রবীভুত কোন হোমিও ঔষধ যে কাজ করার ক্ষমতা রাখে বা রাখতে পারে বিষয়টি এ ধরনের কোন সিস্টেমেটিক রিভিউকে বেশ সন্দেহজনক করে তোলে। পরবর্তীতে তারো হোমিও চিকিৎসার কার্য্যকারীতার পক্ষে বিপক্ষে ফলাফল নিয়ে বেশ কয়েকটি ট্রায়াল হয়েছে, সুতরাং পরবর্তী কোন সিস্টেমেটিক রিভিউতে এই দুই দিকের ট্রায়ালের ফলাফল কোন পরিবর্তন না আনার সম্ভাবনা বেশী।

হোমিওপ্যাথদের খানিকটা সাম্প্রতিক দাবী হচ্ছে সল্যুট ক্লাষ্টার হাইপোথিসিস, যা দাবী করছে কোন দ্রবকে যখন ক্রমান্বয়ে লঘু করা হয়, সেই অতিমাত্রার লঘু দ্রবনে দ্রবটির এক গুচ্ছ খুবই স্থিতিশীল, বৃহদাকার ক্লাম্প বা দলা পাকিয়ে দ্রবণে অবস্থান করে, তাদের মতে সেকারনে লঘুকৃত হোমিও দ্রবণে মুল হোমিও উপাদানটি এভাবে আসলে রয়ে যায়, একই ভাবে succussion (জোরে ঝাকুনী দেয়া) প্রক্রিয়াও খুব ক্ষুদ্র বুদবুদ সৃষ্টির জন্য দায়ী (Nanobubble), যা হয়তো বা অক্সিজেন, নাইট্রোজের, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং সম্ভবত হোমিও ম্যাটেরিয়ালটির কোন গ্যাসীয় অস্তিত্ব নাকি রয়ে যায়, যা হোমিও ঔষধে দাবীকৃত কার্য্যকারীতার জন্য দায়ী। বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে ভিন্ন কোন গবেষনাগারে পুণরাবৃত্তি করা সম্ভব হয়নি, এমন কি এটি যদি প্রমানিত হয়, তাসত্ত্বেও এই সলিউট ক্লাষ্টার বা ন্যানোবাবল কিভাবে শরীরে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করা এখনো সম্ভব হয়নি আর সম্ভব হবার কথাও না। একারনে প্রিক্লিনিক্যাল ও ক্লিনিক্যাল কোন ক্ষেত্রেই হোমিওপ্যাথী ঔষধ কিভাবে কাজ করে তা প্রমান করা সম্ভব হয়নি।

এখন প্রশ্ন হতে পারে ভবিষ্যতে তাহলে এ বিষয় নিয়ে কি গবেষনা হতে পারে? হোমিওপ্যাথদের দুটো ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী কাজ করছে এখানে, একদল বলছেন সুনির্দিষ্টভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা উচিৎ যা চিরকালের মত দ্বন্দটির অবসান করবে এবং এর বীপরিত প্রস্তাবটি, নতুন কোন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আর গবেষনায় অগ্রাধিকার পাওয়া উচিৎ না, তাদের প্রস্তাব আউটকাম ( বা চিকিৎসার ফলাফল) গবেষনা পরিচালনা করা, যা স্বতন্ত্রভাবে প্রতিটি চিকিৎসা সিদ্ধান্তকে সাহায্য করবে এবং প্রচলিত চিকিৎসার সাথে সেই আউটকাম তুলনা করা। অবশ্য সেধরনের গবেষনাও হয়েছে। তবে পদ্ধতিগত ক্রটি বিশেষ করে সিলেকশন বায়াস দিয়ে এরা আক্রান্ত, সাধারনত এরা ইতিবাচক ফলাফলের ইঙ্গিত দেয়। এর অর্থ হচ্ছে একক ভাবে সুনির্দিষ্ট রোগী নির্ভর চিকিৎসা, হোমিওপ্যাথদের বিশেষভাবে দীর্ঘ সময় নিয়ে চিকিৎসা করার যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা আসলে প্ল্যাসিবো প্রভাবের কারনেই ইতিবাচক ফলাফল দেয়। একারনেই গবেষনা আসলে থেরাপিউটিক নির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা জানান দিচ্ছে। পরিশেষে যে হাইপোথিসিসটি দাবী করছে কোন হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার কার্য্যকারীতা প্ল্যাসিবো থেকে ভিন্ন তা নির্ভরযোগ্য কোন সিস্টেমেটিক রিভিউ বা মেটাঅ্যানালাইসিসই সমর্থন করে না। সেকারনে হোমিওপ্যাথীকে কোন প্রমান নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি বলাও সম্ভব না।

তাহলে হোমিওপ্যাথী কি নিরাপদ?

যে কোন চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপুর্ণ। এবং হোমিওপ্যাথী সংক্রান্ত রিপোর্টগুলো প্রায় সবগুলোই হোমিওপ্যাথিকে মুলত নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু এধরনের ফলাফল অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয় বিশেষ করে যখন পানি বা অ্যালকোহল দ্রাবক ছাড়া হোমিও ঔষধে আর কিছুই থাকে না (মুল সক্রিয় উপাদানের কোন উপস্থিতি থাকে না); কিন্তু তা সত্ত্বেও হোমিওপ্যাথী ঔষধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঘটনা একেবারে বিরল নয়, চুলকানী বা প্রুরাইটিস থেকে শুরু করে হামের মত র্যা শ, বা অ্যানাফাইল্যাকটিক বা অ্যালার্জিক শকের ঘটনাও ঘটে। ১৯৯৬ সালের একটি রিভিউর মতে কম লঘুকৃত ঔষধগুলোই বেশী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারন হয়, সুতরাং তাদের কোন কার্য্যকারীতা শুধু নেই, সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে।

আরেকটি নিরাপত্তার প্রশ্ন আসে যখন অনেক দেশেই প্রতিশেষধ বা টিকা নেবার বিপক্ষে হোমিওপ্যাথদের মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। বেশ কিছু সার্ভে লক্ষ্য করেছে যে, হোমিওপ্যাথরা প্রায়শই তাদের রোগীদের টিকা না নেবার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যা সংক্রামক ব্যাধী রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে প্রমানিত প্রতিষেধকের অবদানকে উপেক্ষা করাটার উৎস মনে করা হয় আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে তার শত্রুতাপুর্ণ মনোভাব, গবেষনা বলছে এটি হোমিওপ্যাথী না, অন্যান্য কম্প্লিমেন্টারী চিকিৎসার সাথে জড়িতদের মধ্যেও লক্ষনীয়। যাইহোক টিকা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে বীপরিত কোন পরামর্শ হ্যানিমানের লেখায় পাওয়া যায়না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথরা তথাকথিত ‘হোমিওপ্যাথিক ভ্যাক্সিন‘ বা নোসোডস (Nosodes) ব্যবহার করেন, যা রোগজীবানুর বা জীবানু আছে এমন দ্রব্য, যেমন বমি, পুজ, কোন ক্ষরন, কোষ, বা মল ইত্যাদির অতি মাত্রায় লঘু দ্রবন। মজার ব্যপার হচ্ছে নোসোডস আবার হোমিওপ্যাথীর মুল নীতি অনুযায়ী বানানো হয় না, যা Homeopathy না হয়ে Isopathy বললেই ভালো হয়। এধরনের হোমিও প্রতিষেধকের কোন কার্য্যকারীতা প্রমানিত হয়নি, বরং বীপরিতটারই প্রমান আছে। সুতরাং কোন নীতিবান চিতিৎসকের পক্ষেই তার রোগীকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরীক্ষিত এবং সফলতম আবিষ্কার, টীকা নেবার বিরুদ্ধে উপদেশ দেয়া সম্ভব না। সুতরাং রোগীকে সুস্পষ্ট ক্ষতির মুখোমুখি করার দায়ভার প্রায়শই তারা নির্বিকারে করে থাকেন। কোন প্রমানিত ঔষধ ছাড়া তাদের প্রস্তাবিত নানা রোগের গ্যারান্টিড চিকিৎসা, ক্যান্সার থেকে শুরু করে এইডস, সর্বক্ষেত্রেই সুক্ষচাতুরী এবং রোগীদের বিশ্বাসপ্রবনতার উপর নির্ভরশীল। বহু প্রমানিত রিপোর্ট বলছে, হোমিওপ্যাথরা রোগীদের তাদের অসুস্থ্যতায় কার্য্যকরী ঔষধের তথ্য উপস্থাপন না করা বা বিকৃত উপস্থাপন করার প্রবণতা ক্ষতি করছে রোগীদের। সুতরাং আর যাই হোক না কেন কোনভাবেই হোমিওপ্যাথীকে নিরাপদ কোন পদ্ধতি বলা যায় না।
কোন সন্দেহ নেই হোমিওপ্যাথী প্রশ্নে এথিকস বা নৈতিকতার বিষয়টি অতোপ্রতোভাবে জড়িত। হোমিওপ্যাথী চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে বিশ্বাসপ্রবন মানুষকে হোমিও চিকিৎসার পরীক্ষামুলক প্রকৃতির বিষয়টি না জানিয়ে চিকিৎসা করাটা আদৌ নৈতিক কোন কাজ নয়, এবং এটা আরো বেশী অনৈতিক যখন রোগীর সেই অবস্থার জন্য কার্য্যকরী এবং প্রমানিত চিকিৎসা বিদ্যমান। কোন চিকিৎসকই জ্ঞানত নৈতিকভাবে কোন রোগীর দুর্ভোগ বাড়াতে পারেন না। হোমিওপাথরা যদি নিজেদের চিকিৎসক বলে দাবী করেনই তাহলে নীতিগতভাবে তাদের দায়িত্ব প্রয়োজনীয় গবেষনার মাধ্যমে তারা তাদের চিকিৎসার কার্য্যকারীতার ব্যাপারটি প্রমান করবেন যুক্তিসঙ্গত বৈজ্ঞানিক উপায়ে, নয়তো কোন রোগীকে প্রমানিত চিকিৎসা থেকে দুরে সরিয়ে রাখার কোন নৈতিক অধিকার তাদের নেই।

পরিশেষ:

হোমিওপ্যাথী সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনাগুলোর একটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় প্রায়শই, সেটি হলো হোমিওপ্যাথী এই যুগে আসলে ঠিক কি, সেটা সংজ্ঞায়িত করা। কারন হোমিওপ্যাথী অপবৈজ্ঞানিক চরিত্রের কারনেই কোন সুনির্দিষ্ট সর্বস্বীকৃত রুপ নেই; এজন্য বলা হয়ে থাকে There are as many homeopathies as there are homeopaths ; এছাড়া হোমিওপ্যাথরা খোদ হোমিওপ্যাথী জনত হ্যানিমানের একক ব্যক্তির উপসর্গ নির্ভর চিকিৎসার মুলনীতিটাকে অবজ্ঞা করেন যখন হোমিওপ্যাথীর ঔষধের গণউৎপাদনকে উৎসাহিত করেছেন। এবং হোমিওপ্যাথরা নিজেরকেই স্ববিরোধিতা করে যখন তারা বলে অ্যালোপাথী যখন উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয় রোগীকে,হোমিওপ্যাথী তখনপুরো রোগীর চিকিৎসা (treat the whole patients) করে, অথচ তাদের চিকিৎসা নীতির মুল দর্শন বলছে রোগীর উপসর্গ শনাক্ত করে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেবার কথা।
হোমিওপ্যাথীর সাথে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপুর্ণ ঔষধ অ্যাসপিরিনের উৎপত্তি এবং ধারাবাহিকতার একটি মজার তুলনা করা যেতে পারে। বহু বছর ধরেই মানুষ জানে উইলো গাছের বাকল চেবালে ব্যাথা এবং প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন প্রশমন হয়। এই গাছের বাকল থেকেই অ্যাসপিরিন এর সক্রিয় উপদান, যার আদি নাম Salicin পৃথকীকরন করা হয়েছিল ১৮২৩ সালে, যা হোমিওপ্যাথী আবিষ্কারের খুব বেশী দিন পরের ঘটনা নয়। ১৮৯৯ সালে, স্যালিসিন এর কার্য্যকরী উপাদান Acetylsalicylic acid আবিষ্কৃত হয় এবং প্রথম বারের মত ব্যপকভাবে উৎপাদন ও বিপনন শুরু হয়। এর প্রায় ৫০ বছর পর আধুনিক বিজ্ঞান জানতে পারে অ্যাসপিরিন আসলে কিভাবে কাজ করে। এই মুল তথ্যটি পুজি করে বিজ্ঞানীরা বহু ধরনের নানা ধরনের ব্যাথা এবং প্রদাহে উপযোগী ও উপকারী non-steroidal anti-inflammatory ঔষধ আবিষ্কার করেন, সেই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক আবিষ্কার হলো Cox-2 inhibitors , এই যাত্রায় অবদান অসংখ্য গবেষকের, যা এখনো অব্যাহত আছে।
এখন হোমিওপ্যাথীর কথা ভাবুন এর সমান্তরালে, গত ২০০ বছরে এমন কোন একটি অসুস্থতা নেই, যেখানে হোমিওপ্যাথী কার্য্যকরী প্রমানিত হয়েছে। কিভাবে তারা কাজ করে সেটি অজানা; চিকিৎসার মুলনীতি, এর উদ্ভাবকের সেই সময়কাল থেকে এখনও অপরিবর্তিত, এবং এর ব্যবহারকারী এর মুল ধারনার সাথে ব্যাখ্যাযোগ্য যুক্তিসঙ্গত কোন কিছুই যোগ করতে পারেননি। যদি হোমিওপ্যাথীকে বিজ্ঞান হিসাবে দাবী করাও হয়, স্পষ্টতই এটি আদৌ সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে না। একটি মাত্র সাধারন ব্যাখ্যাই হোমিওপ্যাথীর কার্য্যকারীতা সম্বন্ধে আছে সেটি হলো, এটি হচ্ছে একটি প্ল্যাসিবো বা ঔষধকল্প। এধরনের কোন ব্যাখ্যাই এর চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। যদি তারা প্ল্যাসিবো হয়ে থাকে, শুধুমাত্র তখনই এরা কিভাবে কাজ করে সে সংক্রান্ত কোন ভৌতপ্রক্রিয়া খুজে পাওয়ার আশা করা যায় না।
স্পষ্টতই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো প্রায়শই বিভ্রান্তকর, হতাশাজনক এবং / বা পুণ:প্রমান অযোগ্য ফলাফল সৃষ্টি করেই যাবে, কারন এই ট্রায়ালগুলো মুলত একটি প্লাসিবো র সাথে আরেকটি প্ল্যাসিবোরই তুলনা করে মাত্র। অতি মাত্রায় লঘুকৃত হোমিও ঔষধ নিরাপদ হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারন তারা শুধু পানি, পানি/অ্যালকোহলের মিশ্রন বা ল্যাকটোজ এর ট্যাবলেট। হোমিওপ্যাথটা নি:সন্দেহে এর প্রতিবাদ করবে, কিন্তু আপাতত গবেষনার যে ফলাফল, সেখানে এর চেয়ে যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যা আর নেই।
যদি হোমিওপ্যাথী আসলেই কার্য্যকরী চিকিৎসা হিসাবে প্রমানিত হত, কোন বৈধ চিকিৎসকের তার উপেক্ষা করে ব্যবহার না করাটা যুক্তি সঙ্গত হতো না অবশ্যই এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন অতি লঘুমাত্রার ঔষধগুলো খুব সহজে আধুনিক চিকিৎসকরা গ্রহন করে নিতেন যদি তারা কার্য্যকরী হত। এবং আসলেই খোলামনে কোন কিছুকে গ্রহন করা বিজ্ঞানের বিশেষ বৈশিষ্ট, এবং বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন কার্য্যকরী চিকিৎসার দ্রুত আত্মীকরণ একটি খুব নিয়মিত একটি ব্যাপার। বরং গবেষনা প্রমান করেছে, মুলধারা চিকিৎসা পদ্ধতির চিকিৎসকরা, বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির চিকিৎসকদের অনেক কম গোড়ামীর পরিচয় দেয়। কার্ল সেগানের ভাষায়, … বিজ্ঞানের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থান করছে একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী – যত অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক হোক না কেন, যে কোন নতুন ধারনাকে গ্রহন করার মতো উদারতা এবং পুরোনো কিংবা নতুন সকল ধারনাকে নির্বিশেষে অত্যন্ত দৃঢ় সন্দেহের সাথে পরীক্ষা করে দেখার মানসিকতা। এভাবেই গভীর কোন অর্থহীন ধারনা থেকে গুরুত্বপুর্ণ সত্যিকে পৃথক করা সম্ভব।
হোমিওপ্যাথী কাজ করে এই হাইপোথিসিস এর কোন সমস্যা কিন্তু নেই, সেটা যতই ব্যাখ্যাতীত হোক না কেন।তবে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই হাইপোথিসিস এর পরিবর্তন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। হোমিও চিকিৎসার সঠিক ট্রায়াল কিন্তু সহজেই করা সম্ভব। সেগুলো যেভাবেই রিভিউ বা মেটাঅ্যানালাইসিসই হোক না কেন বা কোন ভৌতপ্রক্রিয়ার প্রস্তাবনা করুক না কেন, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ আদৌ কার্য্যকরী প্রমানিত হয়নি, না মানুষের চিকিৎসায় না পশুদের চিকিৎসায়। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠিত ও প্রমানিত ঔষধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে তারা কোন অংশে বেশী কার্য্যকরী তারও এমন কোন প্রমানও পাওয়া যায়নি।
প্রতিটি চিকিৎসকই চান আত্মবিশ্বাসের সাথে তার চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য, এবং তা করতে হলে তাকে তার ব্যবহারকৃত চিকিৎসা পদ্ধতির উপর অবশ্যই বিশ্বাস থাকতে হবে; কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার ভিত্তি হিসাবে বিশ্বাস কখনোই বৈধ কোন ভিত্তি হতে পারেনা। উপরন্তু কেউ যদি তার মন বদলাতে চান তিনি কোন পদ্ধতি সঠিক বলে মনে করেন, সেজন্যও যথেষ্ট কারন থাকতে হবে, অবশ্যই শুধুমাত্র বিশ্বাসই এখানে যথেষ্ট না। যারা বৈজ্ঞানিক এবং নৈতিকতার সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রয়োগের সাথে জড়িত তারা তাদের রোগীদের উপর প্রয়োগকৃত যেকোন ঔষধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির কার্য্যকারীতা ও নিরাপত্তার নির্ভরযোগ্য প্রমানের অবশ্যই দাবী করেন। সেকারনে, প্রশ্নটা অমীমাংসিত থেকেই যায়, যদি হোমিওপ্যাথীর চিকিৎসা নিরাপদ আর কার্য্যকরী হয়েই থাকে, তাহলে এই পদ্ধতির প্রয়োগকারী হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক এবং একে বিজ্ঞানসম্মত দাবী করার প্রস্তাবকরা কেনই বা অনিচ্ছুক কিংবা অক্ষম, এটিকে কার্য্যকরী প্রমান করার জন্য প্রয়োজনীয় সঠিক পদ্ধতিগত ট্রায়াল ও গবেষনা করার ক্ষেত্রে ?

হোমিওপ্যাথীর অপবিজ্ঞান নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় ভিডিও:

Homeopathy – Con or Cure / Enemies of Reason (Richard Dawkins)

Homeopathic Dilution explained by Richard Dawkins

Homeopathy: Cure or Con? Marketplace CBC

Homeopathy is NOT Medicine

______________________________________

সুত্র:
1. Edzard Ernst (wikipedica) http://en.wikipedia.org/wiki/Edzard_Ernst ( বিকল্প চিকিৎসা নিয়ে তার লেখার একটি সাইট : http://www.guardian.co.uk/profile/edzardernst)

2. Syed Masud Ahmed, Md Awlad Hossain, Ahmed Mushtaque RajaChowdhury, Abbas Uddin Bhuiya. The health workforce crisis in Bangladesh: shortage, inappropriate skill-mix and inequitable distribution., Human Resources for Health 2011, 9:3 (http://www.human-resources-health.com/content/9/1/)

3. Syed Masud Ahmed, Department of Public Health Science, Karolinska Institutet, Stockholm, Sweden. Explorong the health seeking behaviour of disadvantaged populations in Rural Bangladesh,

4.Wayne B. Jonas, Ted J. Kaptchuk, and Klaus Linde, A Critical Overview of Homeopathy. Ann Intern Med. 4 March 2003;138(5):393-399

5. Barrett S. Homeopathy: Much Ado about little or nothing. Nutrition forum (1997);15.3 (May-June 1998):p17

6. Edzard Ernst, Ted J. Kaptchuk, Homeopathy Revisited. Arch Intern Med. 1996;156(19):2162-2164.

7. Barrett S. Homeopathy: the ultimate fake, Quackwatch, Quackwatch, retrieved 2007-07-25

8. David W. Ramey, Mahlon Wagner, Robert H. Imrie, Victor Stenger. Homeopathy and Science: A closer look. (To be published in The Technology Journal of the Franklin Institute) http://www.colorado.edu/philosophy/vst enger/Medicine/Homeop.html)
Irvine Loudon. A brief history of homeopathy. J R Soc Med. 2006 December; 99(12): 607–610.

9. Maddox J, Randi J, Stewart WW. “High-dilution” experiments a delusion. Nature. 1988;334287-91
Ernst E. Homeopathy: what does the “best” evidence tell us? Med J Aust. 2010 Apr 19;192(8):458-60.
Ernst E. Homeopathy, past present future. Br J Clin Pharmacol.1997; 44: 435–437.
Linde, K., et al. Are the clinical effects of homeopathy placebo effects? A meta-analysis of placebo-controled trials. The Lancet 1997; 350: 834-843

10. Ernst E, Pittler MH. Re-analysis of previous meta-analysis ofclinical trials of homeopathy. J Clin Epidemiol 2000; 53: 1188 (letter).
E. Ernst.A systematic review of systematic reviews of homeopathy; Br J Clin Pharmacol 54, 577–582
Barnes J, Resch KL, Ernst E. Homeopathy for postoperative ileus? A meta-analysis. J Clin Gastroenterol. 1997;25628-33
Barnes J, Resch KL, Ernst E. Homeopathy for Postoperative Ileus. J Clin Gastroenterol 1997; 25: 628–633.
Vickers AJ, Smith C. Homeopathic oscillococcinum for preventing and treating influenza and influenza–like syndromes. Cochrane Library 2001; 1: 1–10.

11. Baum M, Ernst E (November 2009). Should we maintain an open mind about homeopathy. Am. J. Med. 122 (11): 973–4.

12. Homeopathy ( Wikiperdia) (http://en.wikipedia.org/wiki/Homeopathy)

13. Homeopathy ( Rational Wiki) (http://rationalwiki.org/wiki/Homeopathy)

হোমিওপ্যাথী: যখন বিশ্বাসে মেলায় বস্তু

9 thoughts on “হোমিওপ্যাথী: যখন বিশ্বাসে মেলায় বস্তু

  1. হোমিওপ্যাথ নিয়ে আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে ছিল। তার আগেই এই লেখা। ভাল লাগল দেখে।
    🙂 শুভ কামন জানাই।

    Like

  2. অসাধারণ।
    অনেক দিন ধরে হোমিওপ্যাথী অবৈজ্ঞানিক তা প্রমাণের স্বচ্ছ ব্যাখা পাচ্ছিলাম না।
    আজ অনেক কিছুই জানলাম।

    Like

  3. Ranjan Barman বলেছেন:

    আপনার লেখাটি অসাধারণ হয়েছে, তরলীকরণ এর উপর ভিত্তি করে হোমিও চিকিৎসার উপর আস্থা ছিল না, কিন্তু তেমন কোন এর বিপক্ষে ডিটেইলস পড়িনি আগে, প্রবীর ঘোষ এর বইয়ে সামান্য পেয়েছিলাম।

    Like

  4. টি শামস বলেছেন:

    অত:পর বুঝিতে পারিলাম পানি আর পানি পানিময় সংসার ? হোমিওপ্যাথী যদি শুধুই পানি হয় তো সমস্যা কোথায় ? পানি সম্বন্ধে বিজ্ঞান কতটুকু জানতে পেরেছে ? পানির তরল অবস্থা থেকে বায়বীয় অবস্থার পরিবর্তন এখনো বিজ্ঞানীরা সঠিক সমাধান দিতে পারেন নাই । ২০০ বছর পূর্বের আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথী এখনো সেই অবস্থাতেই রয়েছে । এর বিজ্ঞানসম্মত গবেষনার জন্য কেহই এগিয়ে আসে নাই । বরং বর্তমানের হাতুড়ে অর্থলিপ্সু ব্যবসায়ী হোমিওপ্যাথরা হোমিওপ্যাথীর লেজে গোবরে অবস্থা করে ছেড়েছে । হোমিওপ্যাথী অবশ্যই একটা উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ।এই বায়োটেকনোলজীর যুগে হ্যানিম্যান থাকলে হয়তো আমরা হোমিওপ্যাথীর আরো ভাল কিছু বিজ্ঞানসম্মত রূপ দেখতে পেতাম । হ্যানিম্যানের মায়াজম” একটা ভুল থিওরী ছিল – যার উপর ভিত্তি করে হোমিওপ্যাথরা শত শত মেটেরিয়া মেডিকা লিখে কাব্য সাহিত্য বানিয়ে রেখেছে । অনেক বলার ছিল – ক্ষুদ্র পরিসরে বলা হলো না । ম্যালেরিয়া পরজীবী সম্বন্ধে নুতন করে বলার কিছু নাই । হোমিও ঔষধ নেট্রাম মিউর “ সিএম পোটেন্সী সাধারন খাবার লবন( সোডিয়াম ক্লোরাইড ) থেকে তৈরি ( লঘুকরন পদ্ধতিতে তৈরি ) – যা আপনাদের ভাষায় শুধুই পানি আর পানি পানিময় সংসার । মাত্র দুই মাত্রা দিয়ে ৭ দিনে ম্যালেরিয়া জীবানু মুক্ত করা গেছে । একজন দুইজন নয় অন্তত: সাত আট জনের । এগুলো কি প্লাসিবো তত্ত্ব , সেল্ফ হিলিং , মনোদৈহিক অভিভাবন নাকি অন্য কিছু ? সময় এসেছে অনেক কিছুর । হোমিওপ্যাথিক পানি বনাম ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া , আরএনএ ভাইরাস ( ক্যানসারাস কোষ ) – কি কথা তাহাদের সনে ।

    Like

Hironmoy Digonto এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল