শীর্ষ ছবি: মৌমাছি (সুত্র: (সুত্র: Jon Sullivan/ NOVA)
( নোভা অনলাইনে কেট বেকারের একটি স্লাইড শো: Venom’s healing bite অবলম্বনে।)
প্রায় সহস্র মিলিয়ন বছর ধরে বিবর্তন পক্রিয়া জৈবযুদ্ধের যে অস্ত্রটিকে অত্যন্ত্ নিখুত করে তৈরী করেছে, সেটি হলো, বিষ। বিষের মধ্যে কার্য্যকরী বিষাক্ত যৌগগুলো এতোই সুক্ষভাবে তৈরী, যে তারা স্নায়ু তন্ত্র এবং রক্তনালীর কোষ, এবং অন্যান্য কিছু অঙ্গে খুব সুনির্দিষ্টভাবে মরণ আঘাত হানতে পারে। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষকরা বিষের মতন প্রাকৃতিক এই শক্তিশালী রাসায়নিক যৌগের ককটেলের মধ্যে খোজার চেষ্টা করছেন ক্যানসার, হৃদরোগ এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যাথার নিরাময়। এবং দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃতির এই মারণাস্ত্রকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জীবন রক্ষার হাতিয়ারে রুপান্তর আসলেই সম্ভব।
নিশানা যখন ক্যানসার :
‘ডেথ স্টকার’ স্করপিয়ন (Leiurus quinquestriatus), © Arie van der Meijden / NOVA
’ডেথ স্টকার’ স্করপিয়ন বা বিচ্ছুর (Leiurus quinquestriatus) হুলের খোঁচায় এমন কিছু বিষ আছে যা সরাসরি স্নায়ু তন্ত্রকে আক্রমন করে। আক্রমনের শিকার প্রথমে হয়ে যায় সম্পুর্ন অবশ, এর পরে আসে মৃত্যু। কিন্ত এর বিষে একটি উপাদান আছে, যার নাম ক্লোরোটক্সিন, বিজ্ঞানীরা আশাবাদী হয়ত একদিন এটি অনেক মানুষের জীবন বাচাতে পারে। কারন চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষন করে, ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলোও তেমন করে এই ক্লোরোটক্সিনকে আকর্ষন করে। কৃত্রিম উপায়ে তৈরী এই ক্লোরোটক্সিনকে, তেজষ্ক্রিয় আয়োডিনের সাথে যুক্ত করে, বিজ্ঞানীরা এখন সরাসরি ক্যানসার আক্রান্ত কোষে রেডিয়েশন চিকিৎসা পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়া ন্যানোপার্টিকেলের সাথে যুক্ত ক্লোরোটক্সিন শরীরের মধ্যে ক্যানসার যাতে না ছড়াতে পারে সেই কাজটিও করতে পারে। ক্যানসার আক্রান্ত কোষে নতুন ধরনের চিকিৎসা জীন থেরাপী পৌছে দিতে ব্যবহার হতে পারে এটি। ক্লোরোটক্সিন যেহেতু খুব সহজে রক্ত থেকে ব্রেনে প্রবেশ করতে পারে, বিজ্ঞানীরা এখন চাচ্ছেন ব্রেনের টিউমর গ্লিওমা চিকিৎসায় এর ব্যবহার করবেন। ক্যানসার কোষগুলোকে নির্দিষ্টভাবে ফ্লোরোসেন্ট যৌগ যুক্ত ক্লোরোটক্সিন দিয়ে চিহ্নিত করে ক্যানসার কোষ শনাক্ত করতে ব্যবহার করতে পারেন চিকিৎসকরা।
ক্যানসার টিউমারের বিস্তার নিয়ন্ত্রন:
কপারহেড (সুত্র :copperhead , CDC/James Gathany/ NOVA)
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের একটি পিট ভাইপার, সাউদার্ন কপারহেড (Agkistrodon contortrix contortrix ) এর কামড় যদিও মানুষের মৃত্যুর কারন হতে পারে কালে ভদ্রে। কিন্ত যে বিষটা কামড়ের সাথে তারা ঢেলে দেয় তা খুবই যন্ত্রনাদায়ক। এই বিষের একটি প্রোটিন উপাদান, কনটরট্রোস্ট্যাটিন শরীরের মধ্যে ক্যানসার কোষের বিস্তারকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। কনটরট্রোস্ট্যাটিন ক্যানসার কোষকে মারতে পারে না, কিন্তু কোষগুলোর উপরের পৃষ্ঠে প্রোটিনগুলোর চেহারা বদলে দেয়া সহ, আরো বেশ কিছু উপায়ে এরা শরীরের মধ্যে ক্যানসার কোষের বিভিন্ন দিকে ছড়ানো প্রক্রিয়াকে ( যাকে বলা হয় মেটাস্ট্যাসিস) নিয়ন্ত্রন করতে পারে। এছাড়া কনটরট্রোস্ট্যাটিন টিউমরের মধ্যে রক্ত চলাচল এবং টিউমরের ভেতর নতুন রক্তনালী সৃষ্টিতে বাধা দিয়ে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধিকে আটকে দেয়। কনটরট্রোস্ট্যাটিন ইদুরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের টিউমরের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করা হয়েছে, গবেষকরা খুব শীঘ্রই মানুষের উপর এর পরীক্ষা শুরু করতে আশাবাদী।
ক্যান্সার কোষ হত্যা:
মৌমাছি (সুত্র: Jon Sullivan/ NOVA)
মৌমাছির হুল ফোটানোর পর পরই অনুভুত তীব্র ব্যাথাটার আংশিক কারন হচ্ছে একটা পেপটাইড, যার নাম মেলিটটিন। কোষ পর্দায় ছিদ্র তৈরী করার মাধ্যমে মেলিটটিন যে কোন কোষকে মেরে ফেলতে পারে। এই নির্বিচারে কোষ হত্যাকারীকে সুক্ষ ক্যানসারের ঔষধ হিসাবে তৈরী করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এর সাথে জুড়ে দিয়েছেন ন্যানোপার্টিকেল এবং ক্যানসার কোষ শনাক্তকারী যৌগ। যার ফলে মেলিটটিন কেবল ক্যানসার কোষকে ধ্বংশ করবে,আশে পাশের সুস্থ্য কোন কোষগুলোর কোন ক্ষতি করবেনা। যদিও মানুষের উপর এটি এখনও পরীক্ষা করা হয়নি। তবে ইদুরের উপর গবেষনার ফল বেশ ইতিবাচক। গবেষকরা মেলিটটিন এর কোষ হত্যা করার ক্ষমতাটা ব্যবহার করতে চাইছে আরো কিছু অন্য রোগের চিকিৎসাক্ষেত্রেও, যেমন ব্যাক্টেরিয়া এবং ছত্রাক সংক্রমন, আথ্রাইটিস।
রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ:
বোথরোপোয়াডেস ভাইপার (সুত্র :Bothropoides jararaca: Daniel Loebmann/ NOVA)
ব্রাজিলে কলার বাগানে কাজ করা বেশ বিপদজ্জনক একটা ব্যাপার। কারন সেখানে রাজত্ব করতে পছন্দ করে একটি পিট ভাইপার ( Bothropoides jararaca), এর একটি কামড় আক্রান্তর শরীরের রক্তচাপকে একদম কমিয়ে দেয় হঠাৎ করে আর আক্রান্ত ব্যাক্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে দ্রুত। ৬০ এর দশকে বিজ্ঞানীরা এই ভাইপারের বিষের রহস্য খুজে বের করেন। এর বিষে আছে একটি প্রোটিন, যা শরীরের এনজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম বা ACE কে কাজ করতে বাধা দেয়, যার মুল কাজ হলো একটি সুস্থ্য রক্তচাপ বজায় রাখা। ৭০ সালেই ঔষধ কোম্পানীরা এই প্রোটিন ব্যবহার করে নতুন শ্রেণীর কিছু রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনকারী ঔষধ তৈরী করে ফেলে, যাদের বলা হয় ACE বা এসিই ইনহিবিটর, যারা রক্তনালীকে শিথিল করে রক্ত চাপ কমায়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে এর ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপক হারে। অল্পকিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও এদের ব্যবহার এখন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন ছাড়া কিডনীর অসুখ, ডায়াবেটিস এবং এমনকি মাইগ্রেনের চিকিৎসাতেও।
জমাট বাধা রক্তকে ভাঙ্গতে:
পিগমী র্যাটল স্নেক ((pygmy rattlesnake) © Maik Dobiey/ NOVA)
যে সমস্ত উপায়ে সাপ বিষ দিয়ে তার শিকারকে হত্যা করে থাকে, তাদের মধ্যে খুব সহজ একটা পদ্ধতি হলো: রক্তক্ষরনের মাধ্যমে তার শিকারকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। কিছু সাপের বিষে বেশ কিছু রাসায়নিক যৌগ আছে, তারা রক্তকে জমাট বাধতে দেয় না। কিন্ত যে যৌগটা সাপের কামড় খাওয়া কারো জন্য মৃত্যূর কারন হতে পারে, সেটাই আবার ভয়ঙ্কর কোন রক্ত জমাট বাধা সমস্যার কোন রোগীর জীবনও বাঁচাতে পারে। কখনো কখনো শরীরের রক্তনালীর মধ্যে জমাট বাধা রক্ত যাকে ক্লট বলা হয়, ব্রেনে রক্ত চলাচল বন্ধ করে স্ট্রোক, অথবা হৃদপিন্ডের মাংশপেশীতে রক্ত চলাচল বন্ধ করে হতে পারে হার্ট এটাকের কারন। এপটিফিবাটাইড নামের (যার বানিজ্যিক নাম ইন্টেগ্রিলিন) একরকম একটি ঔষধ এসেছে সাউথইষ্টার্ণ পিগমী র্যা টল স্নেক এর বিষ থেকে , এছাড়া টিরোফিবান নামের আরেকটি ঔষধ (বানিজ্যিক নাম অ্যাগ্রাস্ট্যাট) যা এসেছে স স্কেলড ভাইপারের বিষ থেকে, এদের কাজ হলো রক্তে অনুচক্রিকা যাতে সহজে জমাট বেধে রক্ত চলাচলে কোন বাধা সৃষ্টি করতে না পারে তা নিশ্চিৎ করা। হার্ট এটাক হতে যাচ্ছে বা হচ্ছে এমন রোগীকেও এই ঔষধগুলো দেয়া হয়।
ব্যাথা কমানোর মহৌষধ:
কোনাস ম্যাগাস (Conus magus) © Richard Ling. Licensed under GFDL/NOVA
যদি কখনো আপনি মাংশাসী কোনাস সী স্নেইলের হারপুনের মত দাতের খোচা খেয়ে থাকেন এবং এর মারাত্মক বিষ আপনার শরীরে প্রবেশ করে, আপনি স্বান্তনা পেতে পারেন এই ভেবে যে, আপনার মৃত্যু যদিও হবে ধীরে ধীরে, তবে তা হবে ব্যাথামুক্ত। এই ব্যাথাহীনতার ব্যপারটাই গবেষকদের উৎসাহ যুগিয়েছে এর বিষ থেকে নতুন ব্যাথা নাশক ঔষধ আবিষ্কারের চেষ্ঠায়। বর্তমানে যে রোগীদের ব্যাথা মরফিন দিয়েও কমানো যায় না, তারা প্রিয়াল্ট এর একটা ইনজেকশন পেতে পারেন। প্রিয়াল্ট, কোনাস ম্যাগাস স্নেইলের বিষের মধ্যে পাওয়া যায় অনুরুপ একটি রাসায়নিক যৌগের কৃত্রিম সংস্করন। যার কাজই হলো ব্যাথার সংকেতকে কিছুতেই ব্রেইনে পৌছাতে না দেয়া। প্রিয়াল্ট মরফিনের তুলনায় হাজার গুন বেশী শক্তিশালী, এবং গবেষকরা বিশ্বাস করেন মরফিনের মত এটি কোন আসক্তি তৈরী করেনা। প্রায় ৬০০ র বেশী প্রজাতির কোনাস স্নেইল আছে, ব্যাথানাশক ঔষধের তারা একটা বিশাল ভান্ডার হতে পারে।
একই বিষয় নিয়ে কিছুদিন আগে ডিসকভারী বাংলাতে একটা ডকুমেন্টারী দেখি। সত্যি, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা মানুষকে যে কতটা সাহায্য করতে পারে – বিশেষকরে চিকিৎসাশাস্ত্রে তা অত্যন্ত মজার। একটা সময় দেখেছি জোঁক দিয়েও চিকিৎসা করা যায়। এবং এই চিকিৎসাটা অত্যন্ত ব্যায়বহুলও বটে।
ঠিক বলেছেন.., গত কয়েক দশকে নানা ধরনের কাজের প্রোটিন খোজার বিপ্লব ঘটে গেছে। প্রযুক্তির উন্নতি জীববিজ্ঞানের বহু বিষয়কে গতিশীল করেছে.. এর মধ্যে এখন প্রোটিওমিকস অনেক সামনে। মেডিসিনাল লীচ বা জোকদের যে এনজাইমটা কাজে লাগে হিরুডিন সেটাও RDT দিয়ে তৈরী হচ্ছে। মাইক্রোসার্জারী, রিকন্সট্রাকশন সার্জারীতে কাজে লাগছে, হিরুডিন রক্ত জমাট বাধতে দেয়না, তা্ই ভেনাস প্রেসার কমায় যেখানে কামড় দিয়ে ধরে সেখান থেকে রক্ত বের হবার সুযোগ করে দিয়ে।
ঘন্যবাদ আরাফাত পড়ার জন্য…
পড়ার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে লাভ নেই, ভালো লাগছে যে আগামীতেও জীববিজ্ঞান বিষয়ে আগামীতে নিয়মিত পোস্ট পড়তে পারবো।
🙂
ভাল লাগল খুব।
ধন্যবাদ।
শুভ হোক।
অনেক ধন্যবাদ ..