প্রকৃতির ফার্মেসি



শীর্ষ ছবি: কমন ফক্স গ্লোভ (Digitalis purpurea) ( Courtesy of Syed Mazhar Hossain)

(নোভা অনলাইনের জন্য তৈরী করা ক্লডিন কো`র Nature`s Pharmacy স্লাইড শো’কে কিছুটা পরিবর্ধিত করে)

অপুর্ব  জীববৈচিত্রে ভরা আমাদের এই পৃথিবীর নানা প্রানী, উদ্ভিদ আর ছত্রাকের মধ্যে আছে অসংখ্য রাসায়নিক যৌগ। প্রজনন থেকে শুরু করে আক্রমনকারী অন্য কোন প্রাণী কিংবা রোগব্যাধি থেকে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য প্রাকৃতিকভাবেই তারা সেগুলো ব্যবহার করে। মানুষের রোগব্যাধির চিকিৎসার জন্য সেরকম অনেকগুলো রাসায়নিক যৌগ বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে খুজেও পেয়েছেন , এবং কৃত্রিমভাবে পরীক্ষাগারে ‍সেগুলো থেকে তৈরীও করেছেন মানুষের শরীরে ব্যবহার উপযোগী নানা ধরনের ঔষধ। সেরকম কয়েকটি প্রজাতির বিবরণ নিয়ে এই লেখা। এই সব প্রজাতির কাছ থেকে আমরা পেয়েছি বেশ কিছু রোগের নিরাময় বা তাদের ক্ষতিকর দিক থেকে উপশম পাবার উপায়। দিনে দিনে আমরা, আমাদের সীমাহীন অজ্ঞানতার কারনে ধ্বংশ করে যাচ্ছি এই প্রাকৃতিক জীববৈচিত্রের সম্ভার, যাদের কারো মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে আমাদের অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময়।

সিনকোনা  ( Cinchona):


সিনকোনা ফুল; Cinchona pubescens ( সুত্র : cinchona,  courtesy USGS/Nova)


সিনকোনা গাছের বাকল, কুইনাইনের উৎস ( সুত্র : Wikipedia)

বহু শতাব্দী ধরে পেরুর আদিবাসীরা দক্ষিন আমেরিকার সিনকোনা গাছের শুকনো বাকল খেয়ে আসছে নানা ঔষধী গুনের কারনে: যেমন মাংশপেশী শিথিল করার জন্য বা জ্বর কমানোর জন্য। ১৬০০ সালের দিকে ইউরোপীয়রা  এই গাছের বাকল দিয়ে ম্যালারিয়া রোগের চিকিৎসা শুরু করে। অবশেষে ১৮২০ সালে ফরাসী রসায়নবিদ যোসেফ পিয়ের পেলেটিয়ের আর যোসেফ ক্যাভেনটো এই বাকল থেকে কুইনাইন পৃথক করেন। এটাইকোন বৃক্ষ থেকে পৃথকীকৃত  প্রথম বিশুদ্ধ রাসায়নিক যৌগ, যা কিনা কোন নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। আর ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় কুইনাইনের ভুমিকাতো সবারই জানা।

আর্টেমেসিয়া অ্যানুয়া (Artemesia annua) :


আর্টেমিসিয়া অ্যানুয়া ( সুত্র : http://www.rollbackmalaria.org/psm/images/ artemisia.jpg)

চীনা ভেষজ চিকিৎসায় ২০০০ বছরের বেশীদিন ধরে ব্যাবহার হয়ে আসছে আর্টেমিসিয় জর কমানো ঔষধ হিসাবে। সত্তর দশকে (১৯৭২) চীনা বিজ্ঞানীরা এর কার্য্যকরী উপদান আর্টেমিসিনিন যৌগগুলোকে পৃথক করেন। এখন আর্টেমিসিনিন সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে আফ্রিকায়, আর্টেমিসিনিন কম্বিনেশন থেরাপীর অংশ হিসাবে ফ্যালসিপারাম বা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্য ম্যালেরিয়ার তুলনায় ফ্যালসিপারাম বা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া বেশ ভয়ঙ্কর এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারন। এছাড়া অন্যান্য প্রচলিত ম্যালেরিয়ার ঔষধের বিরুদ্ধে এটি খু্ব সহজে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। সে কারনে রেসিষ্ট্যান্ট ম্যালারিয়ার বিরুদ্ধে এটাই এখন কার্য্যকরী ঔষধের অংশ। এছাড়া কিছু ক্যানসারের এর চিকিৎসায় এর  উপযোগিতা খুজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

স্ট্রেপ্টোমাইসেস (Streptomyces) ব্যাক্টেরিয়া:


স্ট্রেপ্টোমাইসেস ( সুত্র : Courtesy of CDC/Dr. David Berd)/Nova)

এই পরিবারে প্রায় ৫৫০ প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া আছে। মুলতঃ মাটিতে থাকা এই ব্যাক্টেরিয়াগুলো যে কোন  জৈব পদার্থের ডিকম্পোজিশনে বা পচনে সহায়তা করে।  এরা নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমনের চিকিৎসার ঔষধ) এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল ( ছত্রাক জনিত সংক্রমনের চিকিৎসার ঔষধ) প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী করে থাকে। প্রাকৃতিক উপায়ে প্রাপ্ত  এবং চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এমন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আমরা পাই এদের কাছ থেকে (যেমন: স্ট্রেপ্টোমাইসিন, ভাঙ্কোমাইসিন. টেট্রাসাইক্লিন ইত্যাদি), ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যাক্টিনোমাইসিন ডি আর ব্লিওমাইসিন ও আসে এদের কাছ থেকে। এছাড়াও  আছে কৃমি, উকুন, স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইভেরমেক্টিন, ছত্রাক বিরোধী অ্যাম্ফোটেরিসিন বি ।

পেনিসিলিয়াম (Penicillium) মোল্ড বা ছত্রাক :


পেনিসিলিয়াম মোল্ড ( সুত্র : Courtesy George Barron/Kenyon College) /Nova)

পেনিসিলিয়াম নোটাটাম নীলচে সবুজ ছত্রাক বা মোল্ড, যা সাধারনত: পচে যাওয়া পাউরুটি বা ফলের উপর প্রায়ই (বিশেষ করে কমলা) দেখা যায়। ১৯২৮ সালে স্কটিশ রসায়নবিদ আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং ঘটনাচক্রে এর ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমন বিরোধী অ্যান্টিবায়োটিক গুনাবলী আবিষ্কার করার পর রসায়নবিদরা এর থেকে তৈরী করেছেন অনেক ধরনের পেনিসিলিন জাতীয় আন্টিবায়োটিক। বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমনের চিকিৎসা হিসাবে যা ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্যাসিফিক ইউ ( Pacific yew) :


প্যসিফিক ইউ (সুত্র : Courtesy Robert Beall/Flathead Valley Community College/Nova)

১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইন্সটিটিউট প্রায় ৩০,০০০ প্রজাতির উদ্ভিদের উপর গবেষনার উদ্যোগ নেয় ক্যানসার বিরোধী রাসায়নিক যৌগ পাবার আশায়। বিজ্ঞানী পেয়েছিলেন কেবল একটির মধ্যে, সেটি প্যাসিফিক ইউ বলে একটি উদ্ভিদে, কনিফার জাতীয় এ গাছটি অ্যামেরিকার উত্তর-পশ্চিমাংশের স্থানীয় একটি উদ্ভিদ। প্রথম দিকে একজন রোগীর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ক্যানসার বিরোধী ঔষধ প্যাকলিট্যাক্সেল পৃথক করার জন্য লেগে যেত প্রায় ছয়টি প্যাসিফিক ইউ গাছ। এখন অবশ্য বিজ্ঞানীরা জানেন কেমন করে গাছটির সুচালো পাতা বা নীডল থেকে পাওয়া একটি যৌগকে কার্য্যকরি প্যাকলিট্যাক্সেলে রুপান্তর করা যায়। চিকিৎসকরা এখন প্যাকলিট্যাক্সেল ব্যবহার করছে ফুসফুস, স্তন এবং আরো কিছু ক্যানসারের চিকিৎসায়।

কোন স্নেইল ( Cone Snail) :


কোন স্নেইল (সুত্র : Courtesy Robert Beall/Flathead Valley Community College/Nova)

সাধারণতঃ ক্রান্তীয় এলাকার সাগরে এদের দেখা যায়, মাংশভোজী এই মোলাস্ক, যা কোন স্নেইল নামে পরিচিত। এদের আছে বিষাক্ত হারপুনের মত একটি মুখোপাঙ্গ বা র‌্যাডুলা। যা দিয়ে এরা মুহুর্তের মধ্যে ছোট মাছ বা শিকারকে অবশ করে ফেলতে পারে। এই কোন স্নেইলের বিষে আছে শতাধিক রাসায়নিক যৌগ। যার কতগুলো থেকে রসায়নবিদরা তৈরী করেছেন আসক্তি করেনা এমন কিছু অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যাথানাশক ঔষধ, যেমন: প্রিয়াল্ট এবং ‍জিকোনোটাইড।

অপিয়াম পপি (Opium poppy):


অপিয়াম পপি (সুত্র : Courtesy Mark Nesbitt and Delwen Samuel/Nova)

অপিয়াম পপি সংগ্রহ করা হয় এর পাকা পড থেকে চেছে চেছে। পডের গা থেকেই একধরনের সাদা দুধের মত ল্যাটেক্স বের হয় যা পরে শুকিয়ে বাদামী রঙ্গের একধরনের রেসিনে রুপান্তরিত হয় (যাকে অপরিশোধিত আফিম বলে) (ছবি ৮ ও ৯); এর মধ্যেই থাকে অপিয়াম বা আফিম এর সব রাসায়নিক যৌগগুলো (যারা মুলতঃ অ্যালকালয়ড); অপিয়ামের সবচেয়ে প্রধান অ্যালকালয়ডটি হলো মরফিন। এটি আসক্তি করে তবে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত খুবই কার্য্যকর একটি বেদনানাশক হিসাবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে এটি ব্যপকহারে ব্যবহৃত হয়।


অপিয়াম পপি পড (সুত্র : http://theangloamerican.com/dispatch-from-england/)


অপিয়াম পপি পড থেকে অপিয়াম সংগ্রহ (সুত্র : http:// http://www.biologyreference.com / Po-Re/ Psychoactive- Drugs.html)

ফক্সগ্লোভ ( Foxglove):


ফক্স গ্লোভ (ছবি:  Syed Mazhar Hossain)

১৮ শতকের শেষের দিকে ফক্সগ্লোভ নামের বেগুনী বা সাদা ফুলেরএকটি উদ্ভিদের পাতা থেকে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন একটি রাসায়নিক যৌগ, ডিজিটালিস, যা হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বিশুদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে ডিজিটালিস এর কার্য্যকরী উপাদানগুলো, যেমন ডিগক্সিন, যা বেশ কিছু হৃদরোগের, যেমন কনজেস্টিভ হার্ট ফেলিউর, অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন এবং অ্যাট্রিয়াল ফ্লাটার, নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সয়বীন (Soybean):


সয়বীন (সুত্র : Courtesy USDA/Nova)

১৯৩৯ সালে আমেরিকার বিখ্যাত রসায়নবিদ পার্সি জুলিয়ান সয়বীন তেল থেকে পৃথক করেন স্টিগমাস্টেরল নামের একটি স্টেরয়েড। এবং এই স্টেরয়েড থেকে কিভাবে আরো স্টেরয়েড, যেমন, প্রজেস্টেরন, ইষ্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরন, কর্টিসন, তৈরী করা যায় তার একটা পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। যার কারনে, আর্থাইটিস বা হরমোনের ঘাটতি জনিত রোগে ভুগছেন এমন বহু রোগীর কাছে পৌছে দেয়া সম্ভব হয় স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ গুলো।

মেক্সিকান ওয়াইল্ড ইয়াম  (Mexican wild yam):


মেক্সিকান ওয়াইল্ড ইয়াম  (সুত্র : © Stephen Foster/Nova)

১৯৩৬ সালে জাপানী বিজ্ঞানীরা মেক্সিকান ওয়াইল্ড ইয়াম থেকে পৃথক করেন ডাইওসজেনিন নামের একটি রাসায়নিক যৌগ। পার্সি জুলিয়ানের পৃথক করা স্টিগমাস্টেরল এর মত ডাইওসজেনিনও ইষ্ট্রোজেন, প্রজেষ্টেরন, টেষ্টোস্টেরন এর মত হরমোন জনিত স্টেরয়েড তৈরীর প্রাথমিক উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রন পিল সহ নানা স্টেরয়েড নির্ভর ঔষধ তৈরীর  উপাদান আসে এখান থেকে। মেক্সিকান ওয়াইল্ড ইয়াম প্রচুর পরিমানে হয় এবং দামেও শস্তা, মাত্র ২ বা ৩ টা মুল থেকে প্রায় ১ পাউন্ড ডাইওসজেনিন পাওয়া যায়। ১৯৪৪ সালে রসায়নবিদ রাসেল মার্কার ও তার দুই সহযোগী নিয়ে সিনটেক্স নামের একটি কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল মেক্সিকান ওয়াইল্ড ইয়াম থেকে হরমোন তৈরী করা এবং এর মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে তৈরী সেক্স হরমোন নির্ভর ঔষধের ব্যাপক বানিজ্যকরন শুরু হয়।

প্রকৃতির ফার্মেসি

5 thoughts on “প্রকৃতির ফার্মেসি

  1. খুব ভাল লাগল। শংকার বিষয় এই যে আমাদের দেশের ভেষজ গাছগুলোও দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ছোট থাকতে একদিন গ্রামে আমার পা ছিলে যায়, দিদিমা ‘হাতিশুর’ নামের এক গুল্মের পাতা বেঁটে দিলেন। আ্যান্টিসেপ্টিকের মত কাজ করল।
    আমি বিশ্বাস করি, আমাদের পরিচিত ভেষজ উদ্ভিদগুলোর বাইরেও অনেক উদ্ভিদ আছে যাদের গুনাগুন সম্পর্কে আমরা এখনও অজ্ঞাত।
    ধন্যবাদ।

    Like

  2. অনেক ধন্যবাদ…
    জীবজগতে অসংখ্য রাসায়নিক যৌগ আছে যা নিয়ে গবেষনা নানা পর্যায়ে আছে..

    গত কয়েক দশক ধরেই তো কোন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হচ্ছে না..
    এদিকে তাল দিয়ে বাড়ছে রেসিষ্ট্যান্ট জীবানুদের সংখ্যা। সেই অ্যান্টিবায়োটিক খুজতেও সেদিকে তাকাতে হবে। খোজাও হচ্ছে। পৃথিবীর বহুদেশে নানা ধরনের গবেষনা হচ্ছে।

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান